জাগ্রত হোক সমাজের বিবেক

18

 

মানুষ হলো সমাজবদ্ধ জীব। ব্যক্তি মানুষের সব সার্থকতা সমাজকে কেন্দ্র করেই। সমাজে স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করেই মানুষের সম্পূর্ণতা। কিন্তু মানুষ দল বেঁধে বাস করলেই তা সমাজ হয় না।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের সমাজটা কতদূর এগিয়েছে? সামাজিক শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা আমাদের যাপিতজীবনে কতটা অর্জিত হয়েছে, সমাজে কতটা অপরাধপ্রবণতা কমেছে, কতটুকু শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সমাজটা কতটা নিরাপদ? সমাজ কাঠামো কতটা উন্নত হয়েছে? সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সমাজটা নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধের দিক থেকে কতটা এগিয়েছে আজ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর বিচার বিশ্লেষণ করা খুবই জরুরি বলে মনে করি।
প্রত্যেক মানুষ একে অপরের কল্যাণের কথা ভেবে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ম ও শৃঙ্খলার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করলে সেই জনগোষ্ঠীকে সমাজ বলে। এই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতা রয়েছে। এক সমাজে ধনী, গরিব, সহায় –সম্বলহীন নানা রকম মানুষের বসবাস। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাইকে নিয়েই সমাজ। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াই হলো সমাজসেবা। কিন্তু কেমন আছেন পাশের বাড়ির মানুষটি ? সমাজে যাঁরা না খেয়ে থাকেন, দুস্থ গরিব, অসহায়, অসুস্থ যারা তাদের খবর কয়জনই খবর নিচ্ছি ? সমাজের কোনো কোনো অত্যচারীর অত্যচারের কবলে কেউ কেউ থমকে গেছে তাদের মসৃণ দৈনন্দিন জীবন যাপন। আমরা নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত যে, এগুলো যেন দেখার সময় কারও নেই।এমন প্রশ্ন করার মতো সময়ও আমাদের নেই। ক্রমেই আমরা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। এতে সমাজে নেতিবাচকপ্রভাব পড়ছে। আর এ-ই সুবর্ণ সুযোগটাই কাজে লাগায় তথাকথিত সমাজের দানবেরা। তাই আমাদের চিন্তার পরিবর্তন জরুরি।
আমাদের সমাজের দিকে তাকালে প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, যা অতি দুঃখের হলেও সত্য। আজকের আধুনিক বিশ্বের ছোঁয়া সত্তে¡ও আমরা সে কালের সমাজব্যবস্থা হতে বেরিয়ে আসতে পারিনি। প্রাচীন সমাজব্যবস্থার কুসংস্কার, বৈষম্য ও অবমূল্যায়ন আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। শ্রেণি বৈষম্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, সমাজের একটি গরিব লোক শিক্ষিত, মেধাবী ও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা রাখলেও আমাদের ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এই লোককে সুযোগ না দিয়ে তাকে অবমূল্যায়ন করে পেছনে ফেলে রাখে, যা আমাদের জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
পক্ষান্তরে একজন সম্পদশালী ব্যক্তি মেধা ও নেতৃত্বের যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও সমাজ তাকে নেতৃত্বের ভার দেয়, যা আমাদের সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। আবার অযোগ্যতায়, সময়ের প্রয়োজনে যখন কেউ নেতৃত্ব হারায় তখন তারা পুরো সমাজের জন্যই সে বিষধর সাপে পরিণত হয়। তারা ভুলে যায় যে, এ-ই দুনিয়ার পরেও আরেকটা জীবন আছে। সেখানে তাদের সমস্ত অপকর্মের হিসাব পইপই করে দিতে হবে।
ফলশ্রæতিতে তারা সবাইকে ছোবল মারতে শুরু করে। তাই, এই সমস্ত সাপের বিষ দাঁত ভাঙ্গতে এই সমাজকে নিয়ে আমাদেরই ভাবতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে সমাজ নিয়ে। কারণ, রাসুল (সঃ) বলেছেন, সামনে যদি কোনো অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখ, তবে হাত দ্বারা বাধা দাও, সামর্থ না থাকলে মুখ দ্বারা বাধা দাও, যদি তাও সামর্থ না থাকে তবে অন্তরে ঘৃনা করো। (অন্তরে ঘৃণার মানে হলো এ অন্যায় থেকে বিরত রাখতে নিরবে গোপনে অন্যায়ের প্রতিরোধমূলক কাজ চালিয়ে যাও)।
নৈতিকতাবিরোধী, শিষ্টাচার ও মূলবোধ বিবর্জিত, ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা নিষিদ্ধ এবং দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী যেকোনো কাজ অন্যায়। সমাজ ও দেশের আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তিদের অবস্থান সবসময় ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে হয়ে থাকে। এরূপ ব্যক্তিরা কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। বর্তমানে আমাদের দেশ ও সমাজে অন্যায় এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তিদের অনেকে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণে সাহসী হয়ে ওঠেন না। অন্যায়ের প্রতি সরাসরি ও মৌন সমর্থনও অন্যায়। নীতিনৈতিকতা ও বিবেকের তাড়নায় একজন আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া দায়িত্ব হলেও বর্তমান সমাজে এ দায়িত্বটি পালনে অনেকেই সচেষ্ট নয় ।
এ ধরনের অন্যায় সুযোগ প্রদান- পরবর্তী তাদের কাছ থেকে ন্যায়ের প্রত্যাশী হওয়া দুরাশা বৈ আর কিছু নয়। আর এ কারণেই দেখা যায় অন্যায়ের প্রবণতা আরও অধিকতর বেড়ে যায়। যে কোনো দেশে যদি সমাজের বিবেক সুন্দর, সত্য, ও স্বচ্ছতা না হলে, নিশ্চিত করা না গেলে তা দেশের এবং সমাজ তথাকথিত অত্যচারী, জালিম, ও দানবদের কবল থেকে বের হবে না। আমাদের মনে রাখা উচিত অন্যায় প্রশ্রয় দেওয়াটাইও অন্যায়। তাই, সমাজে যেখানে অন্যায় দেখুননা কেন, প্রতিবাদ করুন। একার পক্ষে প্রতিবাদ করার সামর্থ না থাকলে, সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যায় প্রতিহত করুন। এটাই হোক সর্বস্তরের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক