জাগ্রত বাংলাদেশ

26

অভীক ওসমান


(গত সংখ্যার পর)
বশরত নগর অপারেশনে সবুর খান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলে তার সাথে আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন। সেই আহতদের রিকশায় করে নিয়ে আসা হয়েছিল আমাদের দক্ষিণ বাড়িতে, অর্থাৎ চৌধুরী বাড়ি দক্ষিণ পাড়া বর্তমান ইউ.এ.ই প্রবাসী জাগির হোসেন চৌধুরী মা রিজিয়া বেগমের ঘরে (মাতৃসম এই চাচিকে আমরা ঝি বলে ডাকতাম)। চিকিৎসার জন্য ডা. গোলাম মাওলা-সহ আরো কয়েকজন ডাক্তার প্রাণপণ আহতদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন। যা ছিল সেই সময়ে একটি মস্তবড় ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। শুধু তা নয়, শাহজাহান ইসলামাবাদীর স্ত্রী সে সময় সন্তানসম্ভবা ছিল। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বর্ষার কাদামাটি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে হানাদার বাহিনী প্রতিদিন ঝটিকা আক্রমণ চালাত। এলাকার মানুষ সাংঘাতিকভাবে ভীত থাকত। সেই কারণে শাহজাহানের স্ত্রীকে সন্তান প্রসবের জন্য আশ্রয় দিতে চাচ্ছিল না কেউ। যে কারণে একটি সাম্পান ভাড়া করে একজন ধাত্রীকে সাথে দিয়ে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়। ছোট মিয়ার মা অর্থাৎ আমাদের চাচি শাহাজাহানের স্ত্রীকে সাম্পান থেকে নামিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান আর্মি আমাকে মেরে ফেলুক, কিন্তু এই মেয়েটির সন্তান আমার ঘরে প্রসব করাব। যতদিন সে সুস্থ না হয় সে আমার কাছে থাকবে। ১৯৭১ এ এই মহিলার স্বামী ছিল বার্মায়। তিনি ছেলেপুলে নিয়ে কষ্টে সংসার চালাতেন। সেই অক্ষমতাকে উপেক্ষা করে শাহজাহানের স্ত্রীর সেবা করেছিলেন। যে সন্তান সেদিন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো শাহজাহান ইসলামাবাদী সেই সন্তানের নাম রেখেছিল গাজী। কালামদের ঘরে একটা নৌকা ছিল। আর্মি আসার খবর পেলে আমি আর কালাম নৌকাতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভরাট চরে নিয়ে যেতাম। আমরা দিনের বেলায় চরের ক্ষেতের খামারে গিয়ে সময় কাটাতাম। আর রাত হলে মুক্তিযুদ্ধের কাজে লেগে যেতাম।
এ লাশ আমি রাখবো কোথায়! : একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর এপ্রিলের ১ম সপ্তাহে আমি এবং কালাম ভারতে চলে যাওয়ার জন্য শহরে এসেছিলাম। আমার পরনে একটি থান কাপড়ের লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। একই ধরনের কালামেরও, গায়ে পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, মাথায় টুপি। আমরা কালারপুলে সাম্পানে উঠব চাক্তাই আসার জন্য, অনেক লোক তখন অপেক্ষায় ছিল। সবাই আত্মীয়স্বজনের খোঁজে শহরে যাবার চেষ্টায়। সেখানে একজন হিন্দু ভদ্রলোক ছিল। সাম্পানের যাত্রীরা তাকে সাম্পানে উঠতে দিচ্ছিল না। সবাই বলল, তুমি হিন্দু মানুষ তুমি উঠলে তোমার কারণে আমাদেরও মৃত্যু হবে। একথা শুনে হিন্দু ভদ্রলোক কালারপুল ব্রিজের উপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমাদের সাম্পান কর্ণফুলী নদীতে ঢুকতেই দেখলাম, সারি সারি লাশ। লাশের কারণে সমস্ত এলাকা দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। সাম্পানে কেউ কেউ বমি করছিল। আমি আর কালাম চাক্তাই ঘাট দিয়ে উপরে উঠতেই পাকিস্তান আর্মি আমাদের নাম জিজ্ঞেস করল এবং কলমা জানি কিনা জিজ্ঞেস করল? আমরা বললাম আমরা সাচ্চা মুসলমান। আমরা দুজনে বিড় বিড় করে কলমা পড়ে ফেললাম। আমার সাদা লুঙ্গিতে জয় বাংলা লেখা ছিল কলমের কালি দিয়ে। আর্মির লোক জিজ্ঞেস করল, ইয়া ক্যাহা লেখা হে? কালাম চটপট উত্তর দিলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ লেখা হ্যাঁ। হাম পাকিস্তান কা মোহাব্বত কারে। কালাম বলছিলো আসার সময় লুঙ্গিটা পাল্টিয়ে আসতে পারলি না ভাই। আমি বললাম, বাড়িতে কাউকে না বলে পালিয়ে আসছি, লুঙ্গি পাল্টাবার সুযোগ কোথায়? আমরা একরাত মিয়াখান নগরে আমাদের গ্রামের বাড়ির কাজের ছেলের দোকানে মাচার উপর রাত কাটিয়েছিলাম। শুভপুর বাস স্টেশনে এসেও মিরসরাই এর করেরহাট দিয়ে রামগড় বর্ডার পার হওয়ার চিন্তা থাকলেও পথখরচের অভাবে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বাধ্য হই। বাধ্য হয়ে আবার গ্রামের পথে যাত্রা শুরু করি। অকৃত্রিম দেশপ্রেম ছাড়া আত্মসর্বস্ব চিন্তা কি মানুষের মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেরণা ও অসাধারণ বীরত্ব জাগাতে পারে? মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন তারা কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকৌশলী, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য শিক্ষক, কেউ দেহাতি মজুর, কৃষাণ সকলেই একসঙ্গে যেকোনো পরিবেশে এক সাথে বসে খাদ্যগ্রহণ করেছেন।
কতই না দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন তারা। আবার একসঙ্গে যুদ্ধযাত্রার পরিকল্পনা করেছেন। একে অন্যের দুঃখের যন্ত্রণার সাথী হয়েছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে, যার বয়স কম ছিল বা নবীন কিশোর-রিক্রুট হতে না পারে ডাক্তারকে ঘুষ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সৈনিক হতে চেয়েছে। মৃত্যুকে বরণ করার জন্য ঘুষ দেওয়ার নজির স্বাধীনতার আকাঙক্ষাকে মূর্ত করেছে। এমনও কথা শোনা গেছে, নব পরিণীতা স্ত্রী তার স্বামীকে বলেছেন, দেশ স্বাধীন না করে ফিরে না আসার জন্য। পিতা সন্তানকে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পাঠিয়েছেন। এরা কেউ বনেদী পরিবারের নন। এরা মাতৃমুক্তিপণ উজ্জীবিত গ্রামবাংলার দামাল সন্তান। তারা যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের দেশপ্রেমকে উজ্জ্বল করেছিলেন। নতুন সৃষ্টি এবং দেশ গড়তে তারা কঠিন ব্রত নিয়েছিলেন। যুদ্ধোত্তর পোড়া মাটিতে শস্যের বীজ বুনেছিলেন। যারা শ্রম বিক্রি করেন, যারা কিছু তৈরি বা উৎপাদন করেন তারাই সমাজ ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কারিগর। তারা বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু যারা তাদের নিয়ামক তারা সঠিক হাল ধরতে পারেননি।
গ্রæপ- সাবগ্রæপ : শাজাহান ইসলামাবাদী’র নেতৃত্বাধীন কর্মকাÐকে অনেকে সাবগ্রæপে চিহ্নিত করেছেন। বীরমুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বিশালাকায় গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ এরূপ বর্ণনা আছে। শামসুল আরেফিনের ‘মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত গ্রæপ আলোচ্য বাহিনী দক্ষিণ চট্টগ্রাম’ গ্রন্থেও অনুরূপ বর্ণনা (ওরাল হিস্ট্রি) রয়েছে। ৭নং সেক্টরের বিস্মৃত কমান্ডার মেজর নাজমুল হক এর কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক জায়গায় সাবসেক্টর কমান্ডার দেখানো হয়েছে (৭ নং সেক্টরের বিস্মৃত কমান্ডার শহীদ মেজর নাজমুল হক, বাতিঘর,গদ্যপদ্য)।
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সম্পাদিত ‘অপারেশন দক্ষিণ চট্টগ্রাম’ গ্রন্থ থেকে গ্রæপ সাবগ্রæপের ৪টি উদ্ধৃতি দিচ্ছি : (ক) এ বৈঠকে উপস্থিত ছিল ইদ্রিস (মাহাতা), প্রফেসর শামসু, একেএম আবদুল মতিন চৌধুরী, আনোয়ার উদ্দিন, অনিল লালা, আবছার উদ্দিন, মাহফুজুর রহমান খান প্রমুখ। উপস্থিতি কম থাকায় পরের বৈঠকে কেলিশহর ভট্টাচার্য হাট তহসিল অফিসে হামলার সিদ্ধান্ত নিই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি সহ আনোয়ার, আবছার, অনিল লালা মিলে দ্বিতীয় অপারেশন সফল করি। এর ৩/৪ দিন পর আমাদের ৭/৮ জনের একটি দল পটিয়া তহসিল অফিসে জ্বালিয়ে দিই। পাঞ্জাবিরা অপারেশন করতো দিনে, আর আমরা গেরিলারা করতাম রাতে। পরবর্তীতে এয়ার ফোর্সের সার্জেন্ট মহি আলম, ক্যাপ্টেন করিম, মহসিন খানসহ অনেকে ট্রেনিং থেকে ফিরে আসলে আমাদের গ্রæপ আরো বড় হয়। বরমার শাহজাহান ইসলামাবাদীর (মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পুত্র) বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধের ঘাঁটি হলে আমরা সেখানে চলে যাই। পাক বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে আমরা বুধপুরা চলে আসি। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন করিমের টিমও আমাদের সাথে যোগ দেয়। ২০/২৫ জনের মিলিত বাহিনী নিয়ে আমরা জিরি মাদ্রাসা অপারেশন করি। সেখানে নেজামে ইসলাম পার্টির নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী সংগঠিত হয়েছিল। তাদের পরাস্ত করে ১৬টি রাইফেল ছিনিয়ে নিই।
(খ) দক্ষিণ চট্টগ্রামে তখন দু’টি বৃহৎ গেরিলা গ্রæপ মুক্তিযুদ্ধ করছিলো। একটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম, আরেকটি কমান্ডার ছিলেন সার্জেন্ট আলম। দুটি গ্রæপের অধীনেই একাধিক উপ-গ্রæপ যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলো। করিম গ্রæপের গেরিলা তৎপরতা রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারায় বিস্তৃত ছিলো। ক্যাপ্টেন করিম শহরেও অপারেশন করেন। সার্জেন্ট আলম গ্রæপের গেরিলা তৎপরতা বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীতে বিস্তৃত ছিলো। পটিয়া থানার বরকলে ছিলো এই গ্রæপের প্রধান ঘাঁটি। বলা যায় শাহাজাহান ইসলামাবাদীর বাড়িকে কেন্দ্র করে বরকল, বরমা ও কানাইমাদারি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ছিলো মুক্তাঞ্চল। সার্জেন্ট আলম ছিলেন গ্রæপের অপারেশনাল কমান্ডার। প্রধান সংগঠক তথা রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন শাহজাহান ইসলামাবাদী ও মুরিদুল আলম। সার্জেন আলম গ্রæপে যারা অপারেশনে কমান্ড করতেন তারা হলেন, হাবিলদার হাবিব, মহসিন খান ও শহীদ সবুর। করিম গ্রæপে কমান্ড করতেন অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, জাকের আহমদ ও আ.হ.ম নাসিরউদ্দিন। অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, আহমদ শরীফ মনীর, আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার, ডা. শামসুল আলমকে এই গ্রæপের রাজনৈতিক কমিশনার বলা যেতে পারে।
(গ) ১৩ ডিসেম্বর ৭১ কমান্ডার শাহজাহান ইসলামাবাদী, কমান্ডার থানা কম্পাউন্ডে স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলন করেন। অতঃপর মহসিন খান, কমান্ডার আবু ছৈয়দ, কমান্ডার শাহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সদরে এলাকা থেকে আলম, তাদের গ্রæপের সদস্য সাধারণ জনগণকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সদরে ফিরতে থাকেন। পটিয়ায় বিজয়োৎসব শুরু হয়।
ঘ) শামসুল আরেফিন ফিল্ড ওয়ার্ক করে জানাচ্ছেন : এক্ষেত্রে ‘গিরি চৌধুরী বাজার অপারেশন’, ‘কৈয়গ্রাম শান্তি কমিটির নেতা অপারেশন’, ‘বাদামতল পাক বাহিনীর দালাল অপারেশন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।‘গিরি চৌধুরী বাজার অপারেশনে’ গ্রæপটির যোদ্ধারা সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ভয়াবহ লড়াই করেন। তাঁরা ‘পটিয়া ইন্দ্রপুল অপারেশন’, ‘বশরতনগর রশিদিয়া মাদ্রাসা অপারেশন’, ‘জিরি মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্প অপারেশন’ ও ‘আনোয়ারা মেরিন একাডেমি অপারেশনে’ও অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর সংঘটিত ‘বশরতনগর রশিদিয়া মাদ্রাসা অপারেশনে’ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সবুর খান শহীদ হন। এছাড়া আরও দুজন মুক্তিযোদ্ধা তাতে গুরুতর আহত হন। ‘জিরি মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্প অপারেশনে’র মাধ্যমে ১৬ টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত ‘আনোয়ারা মেরিন একাডমি অপারেশনে’ ২০ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও ৭০ জন রাজাকারকে বন্দি করা হয়। শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রæপের উল্লেখযোগ্য যোদ্ধাদের তালিকা : শাহজাহান ইসলামাবাদী, মোজাহেরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আহমদুর রহমান, আবুল বশর, আবুল বশর, মো. সোলায়মান, আবু তৈয়ব, এ এম মনচুর, ছাদেক আবদুল মহী, আবদুছ ছবুর, মোহাম্মদ সোলায়মান খান, ইসলাম খাঁ, মোহাম্মদ শফি, বদিয়ুল আলম, বদরুল আলম, মোহাম্মদ ফজলুল কবির, মাহমুদুর রহমান, আইয়ুব বাঙালী, নুরুল হুদা, আবুল মনজুর, মুজিবুর রহমান, নাজিম উদ্দিন, আবুল কাসেম, এটিএম শামসুল হুদা, মোহাম্মদ আমানত খাঁ, আযম খাঁ, আবুল মনজুর, শফিয়ুল আজম, আবুল মজজুর, এম জাহাঙ্গীর, ডা. গোলাম মাওলা,বদিয়ুল আলম, আবু সোলায়মান, অরুণ বিকাশ দাস, মোহাম্মদ আলী, মাহবুবুল আলম, একেএম ইয়াহিয়া, সিরাজুল হক, মোহাম্মদ আবু বকর, জয়নাল উদ্দিন, এস এম মাসুদ, এটি এম জসিম উদ্দিন, এম এম নওশাদ আলী, জাহাঙ্গীর আলম, নুর মোহাম্মদ, নুরুল ইসলাম, মো. মঞ্জুরুল হক খান, এস এম আলমগীর আলম, মনির আহমদ, মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ফেরদৌস ইসলাম খান, কমান্ডার শাজাহান ইসলামাবাদী- আন সাঙ হিরো : ১৯৬৯ ইং সালে তিনি ছিলেন কে.এম.ও’র অনারারি সেক্রেটারি। চট্টগ্রাম চেম্বারের কর্মকর্তা ৪০ মোমিন রোডের দোতলায় নীরবে আসতেন, যেতেন। বেশি স্কুল ফি সত্তে¡ও পূর্ব পাকিস্তানের সেরা প্রাইভেট স্কুল কাজেম আলী হাইস্কুলে আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
আমি যখন ১৯৭১-এ তাকে প্রথম দেখি, সম্ভবত: একাত্তরের এপ্রিল-মে মাস। বর্তমান চন্দনাইশের বরকল বরমা’র … সড়কের আড়ালিয়া সাইডের মুখে। লুঙ্গিপরা, সাদা হাফ ¯িøভ শার্ট, হাতে ছাতা। আমার মনে হয় না তখন বর্ষাকাল ছিল। ইতোমধ্যে ছানজনতা সমীহ ও সম্ভ্রমের সাথে জেনে গেছেন শাজাহান ইসলামাবাদী এসে গেছেন। সেজন্যই অনতি তরুণ আমি তাকে লক্ষ্য করছিলাম। বরমা বরকল সড়কের পাশে ছিল আমাদের ভাই ব্যবসায়ী আবদুল মোনাফ চৌধুরী বাড়ি। তার স্ত্রী শায়েস্তা বেগম আমাদের বোন। তাদের বড় ছেলে ইব্রাহিম চৌধুরী (পরে কুয়েত ন্যাশনাল রিফাইনারী কর্মকর্তা) জানাচ্ছেন তাদের ঘরে সেকেন্ড ইন কমান্ড (ফাইনেন্স) ডা. গোলাম মাওলা অবস্থান করতেন। আমি প্রথম স্টেনগান দেখি ইব্রাহিম চৌধুরীর বাড়িতে। তাদের বাড়িতে আর্মস এমুনেশন জমা থাকত। শাজাহান ইসলামাবাদীর স্ত্রীও কয়েকদিন ছিলেন। এখানে বদরুল-দিলীপ (জাহাঙ্গীর) মন্টু (আলমগীর) আনোয়ারার নুরুল আনোয়ার থাকত, খেতো। বদরুলের বড় ভাই টুন্টু ও ম্মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
ইব্রাহিম চৌধুরী জানাচ্ছেন-আনোয়ার ও সে একসময় সাম্পানে করে তার দাদীর বাড়ি যাত্রা করেন। পথিমধ্যে এশার নামাজের সময় কোন বাজারে এলাকাবাসী জানতে পারেন মুক্তিযোদ্ধা এসেছেন। তাই সন্ত্রস্ত হয়ে যেকোন দোকানপাট বন্ধ করে দেন। আনোয়ারের দাদী ইব্রাহিমকে সারারাত আদর যতœ করেন। খুব ভোরে কেশুয়া ফিরে আসেন। স্বাধীনতার পর আনোয়ারের দাদী লোক পাঠিয়ে ইব্রাহিমকে যেতে বলেন। ইব্রাহিম কী জবাব দেবেন দাদীকে। তাই কোনদিন দেখা করেননি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আনোয়ারা এখন বিস্মৃত নাম। আনুমানিক অক্টোবরের দিকে নুরুল আনোয়ার-দিলীপ এবং হাফেজ সাহেবের বাড়ির এক তরুণ ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়া যাত্রা করেন। এরপর তারা নিখোঁজ বা নিহত হন। বরমা বরকল রোদন করে “আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা/ আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা”। এপ্রিলের দিকে যুদ্ধাবস্থায় গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে কেরোসিন তেল, বাংলা সাবান, গুঁড় ইত্যাদি। আমি আর কালাম চৌধুরী- চিন্তা করলাম শহর থেকে এসব কিনে এনে গ্রামের মানুষদের কাছে বিক্রয় করলে ভালো হবে। এইভাবে আমরা দুজন একসময় কালুরঘাট চেকপোস্ট দিয়ে ঢুকলাম। কালুরঘাট অপর পারে সবাইকে নামিয়ে ফল ইন্ করাল। কলমা জানি কি না। আমরা কলমা বললাম। ভাগ্যিস পাঁচ কলমা জিজ্ঞেস করেনি। লুঙ্গি খুলে দেখেন। ৭১’ বিরান নগর চট্টগ্রামে বি এ আজাদ ৪০ মোমিন রোডে সমাজ পত্রিকার অফিসে রর্‌্যালী চেয়ারে বসে থাকতেন।
গ্রাম, গঞ্জ, নগর সর্বত্র : কদম মোবারক এলাকা ঘিরে একটি গেরিলা কর্মী বাহিনী গড়ে ওঠেছিল। ডা. মাহফুজুর রহমান তার গবেষণায় তা বিবৃত করেছেন। ওই এলাকায় থাকতেন আইয়ুব খানের ভক্ত শাজাহান ইসলামাবাদীর ভাই সমাজ সম্পাদক বি.এ. আজাদ ইসলামাবাদী তার গতিবিধি লক্ষ করার জন্য শাজাহান ইসলামাবাদী আমাকে নগরে পাঠিয়েছিলেন।
জননী, জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী : শাজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে বরকল বরমা কানাই মাদারী এসব এলাকায় রাজাকারদের দৌরাত্ম্য ছিল না। আমরা মুক্ত জনপদে বিচরণ করেছি। কিন্তু নভেম্বরের দিকে সূচিয়া-সাতঘাটিয়া এলাকা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছিলেন। চন্দনাইশ সদরের খোকা নামের এক আল শামস বাহিনীর গোলা রেঞ্জ (জামাল খান বাসস অফিসে তাদের নগর অফিস ছিল) আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এসে পড়ছিল। গার্ডিয়ানরা আমাদের তরুণদের এক গভীর রাতে প্রথমে বরকল কানাইমাদারী এলাকা পরে নগরমুখী করেছেন। আমার মনে পড়ছে আমার মা যিনি দেওবন্দী ঘরানার মেয়ে। সেই রাতে তার সবচেয়ে ভীতু ছেলেকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য বের করে দেন। তিনি পছন্দ করতেন সঙ্গীত ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্তির জন্য নফল নামাজ পড়েছেন। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী। মৎ রচিত কবিতা নাটকে এই সাহসিকা জননীর কথা বহুবার উঠে এসেছে। এইভাবে দলমত বর্ণ নির্বিশেষে প্রান্তিক জনপদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে প্রযতেœ রক্তঘামে তারা আমাদের একাত্তর, মহান একাত্তর, রক্তাক্ত একাত্তর সংঘটিত হয়েছিল।
তুই রাজাকার : ডিসেম্বরে আমি রেডক্রস থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশে নগরেই অবস্থান করি। ঘাটফরহাদবেগস্থ রেডক্রস ভবন থেকে লং কোট, কম্বল এগুলো সংগ্রহ করি। এর মধ্যে মিত্রবাহিনী চট্টগ্রাম নগরে বিশেষ করে ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ কী ইনস্টলেশন সমূহে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। ১৬ ডিসেম্বর আমি এবং আরেকজন চাক্তাইঘাটে সাম্পানে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করি। নগরে তখন কে মুক্তিযোদ্ধা, কে পলায়মান সশস্ত্র রাজাকার বোঝা যাচ্ছে না। বক্সিরহাট মোড়ে একটা সংঘর্ষ হয়। আমরা সাম্পান নিয়ে যাত্রা শুরু করি। কর্ণফুলী চানখালী পারে পারে জাগ্রত জনতা। ধর রাজাকার। অবশেষে সন্ধ্যায় টিনের ঘরের হাটে পৌঁছি।
একাত্তর এবং তারপর : ১৬ ডিসেম্বর একদিন পর মুরিদুল আলমের খুনি হিসেবে একজনকে ধরা হয়। সে বাজারের জগৎ খলিফার দর্জি দোকানসংলগ্ন চায়ের দোকানে নিষ্পৃহভাবে চা-কলা-বিস্কুট খাচ্ছিল। এর মধ্যে প্রায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা টিনের ঘরের হাটে জড়ো হয়। তার মধ্যে হোসিয়ারী শ্রমিক নেতা আবদুস সাত্তার বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি জেলে ছিলাম। আমাকে কিছু একটা করতে দিন।’ এই বলে তিনি স্টেনগান হাতে এই খুনীকে গুলি করলেন। সে তো মরে না। চানখালীর জোয়ারী জলে কেয়া ঝোঁপে ভেসে ওঠলো। আবারও গুলি করলেন। এখনো আসল অনেক রাজাকার বেঁচে আছে।
মুরিদুল আলমের শহীদ হওয়া আমাদের জন্য বড়ো আঘাত। এটা নিয়ে একটা বিভ্রান্তি ও গুজব রয়েছে। শাহজাহান ইসলামাবাদীর হাতে ৭ এমএম রিভলবার (এটা মুসিলম লীগের গোরা আজিজ তৎকালীন জনতা ব্যাংকের সিবিএ লিডার আবু তাহের চৌধুরীকে দিয়েছিলেন)। প্রতীয়মান হচ্ছে যে মুসলিম লীগাররা ৭০ সালেই অস্ত্র সরবরাহ শুরু করেছিল। ফরিদের হাতে ছিল এসএমজি, মোজাহের এর হাতে ছিল এসএলআর (যার এক কিলোমিটার পর্যন্ত রেঞ্জ ছিল) এরপরও মুরিদুল নিহত হলেন কেন?
শাহাজাহান ইসলামাবাদীর সাথে ১৯৭২ সালের পর বাদামতলী চেম্বার ভবনে একবার ইলিয়াছুর রহমান রুশ্নিসহ সাক্ষাৎ করি। তিনি বামপন্থি রাজনীতি করতেন না আমাকে কোনোদিন বলেননি। চট্টগ্রাম চেম্বারে বীর মুক্তিযোদ্ধ মির্জা আবু মনসুর তাকে দ্বিতীয়বার চেম্বারে চাকরি দেন। শাহাজাহান ইসলামাবাদী সায়েন্সের ছাত্র হলেও চমৎকার ইংরেজিতে ড্রাফট করতেন, অ্যাকাউন্স ডিসিপ্লিন ভালোভাবে বুঝতেন। ১৯৮৫ শাহজাহান ইসলামাবাদীর মৃত্যু পর্যন্ত চেম্বারে আমার সিনিয়র ছিলেন। তিনি আগ্রাবাদ বাদামতলীস্থ চেম্বারে স্মৃতিচারণ করে আমাকে বলেছিলেন ‘কর্ণফুলী সমুদ্রবন্দর খোলা আকাশের দিকে চেয়ে ভাবলাম দেশটাকে মুক্ত করতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম।’ মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমাকে বললেন ‘নিজেও সার্টিফিকেট নিলাম না, তোমাদেরও দিলাম না।’
মৎ রচিত ‘শংখ উপাখ্যান’ নাটকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজা চরিত্র বলছেন, ‘বামনের দেশে মহাকায় ছিলেন তিনি। ট্র্যাজিক নাটকের এক মহান নায়ক। তাঁর উজ্জ্বল উত্থানে ও মর্মস্পর্শী পতনে নিয়তিই হচ্ছে নিয়ন্ত্রক। লেনিনকে ছাড়া রুশ বিপ্লব ঘটতে পারে না, শেখ মুজিবকে ছাড়াও ঘটেনি বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালিকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, আর বাঙালি তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। তাঁর দলে জুডাসদের অভাব ছিলো না, এবং স্বার্থান্বেষীদের। জুডাসরা ও স্বার্থান্বেষীরা যে তার পতনের পথ তৈরি করেছে। জনগণ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন বলে ভাবতেও পারেননি জনগণ তাঁর থেকে কতো দূরে চলে গেছে। কোথায় সেইসব জুডাস ও স্বার্থপরের দল। প্রতিবাদ করো, একজন অত্যন্ত আত্মাহুতি দিয়ে প্রমাণ করো তোমরা ভালোবাসো তোমাদের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিধাতা, নেতা ও পিতাকে। নেই, নেই, নেই। কাপুরুষ। তাঁর মৃত্যুতে একটি বঙ্গোপসাগর যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।’ (শংখ উপাখ্যান, ১৯৮৯)
লেখক : কবি, নাট্যজন ও প্রাবন্ধিক