জশনে জুলুছ প্রবর্তনে আল্লামা তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র অবদান’

23

মুহাম্মদ গোলাম হুসাইন আল-কাদেরী

মহান রাব্বুল আলামিন সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থ পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছাড়া কোনো কাফের (অবিশ্বাসী) কে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না’। (আলে ইমরান-২৮) এই নির্দেশ আল্লাহর ওই সমস্ত বান্দাদের প্রতি যারা কিনা আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসূল এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসী। বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী কখনো এক হতে পারে না। তাদের প্রতিদান ভিন্ন ভিন্ন। বিশ্বাসী বান্দার প্রতিদান নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত। আর অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে জাহান্নামে লাঞ্ছিনাদায়ক শাস্তি। সুতরাং জান্নাতি আর জাহান্নামি কখনো এক হতে পারে না।আল্লাহ ও তার রাসুলের দুশমনরা কখনোই মুমিনের বন্ধু হতে পারে না। কারণ তাদের সাথে বন্ধুত্ব করলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মুমিনদের প্রকৃত বন্ধু কারা? এই বিষয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয় তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং মুমিন বান্দাগণ। যারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনম্র’। (মায়েদা-৫৫)
এই সকল বান্দাদের সংস্পর্শে থাকলে ইহ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত। তারা আল্লাহ পাকের প্রিয় ও অনুগত বলে আল্লাহ তাদের বন্ধু বানিয়েছেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে বিপদমুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ পাকের পবিত্র বাণী- “সাবধান! যারা আল্লাহর ওলী (বন্ধু) তাদের কোন ভয় নেই এবং পরকালে তারা চিন্তান্বিত হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করেছে। দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের জন্য সুসংবাদ। আল্লাহর কথার কখনো পরিবর্তন হয় না। এটাই হলো মহা সফলতা। (ইউনুছ-৬২,৬৩,৬৪) কুরআনে কারিমের আয়াতের আলোকে প্রমাণিত যে, আল্লাহ পাকের প্রিয় বান্দাগন উভয় জগতে সুসংবাদ প্রাপ্ত ও বিপদমুক্ত। দুনিয়াতে তাদের সঙ্গী হতে পারা পরম সৌভাগ্য। আল্লাহ পাক বলেন-
‘আর যারা আল্লাহ তাঁর রসূল এবং বিশ্বাসীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী’। (মায়েদা-৫৬) অপর এক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও’। (তাওবা-১১৯) দুনিয়াতে নবী ও রাসূলগনের আগমনের সমাপ্তি হলেও আল্লাহর ওলীগণের আগমন কিয়ামত পর্যন্ত অব্যহত থাকবে। তাদের আগমন হবে পথভ্রষ্ট ও বিপদগামী বান্দাদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে। আওলিয়া-এ কামেলিন, বুজুর্গানে দ্বীনের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ ও সাধনার বদৌলতে ইসলামের সুমহান আদর্শ আজ পৃথিবীর দূর দিগন্তে প্রচারিত প্রসারিত। মুসলিম মিল্লাত আজ তাদের অবদান ও দ্বীনি খিদমতকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। সত্য সন্ধানী ব্যক্তি মাত্রই তাদের আদর্শকে জীবনাদর্শ হিসেবে অনুসরণ, অনুকরণ করছে। বাংলাদেশ সহ গোটা উপমহাদেশ আউলিয়া-এ কেরামের পদধূলি দ্বারা ধন্য হয়েছে। সুলতানুল হিন্দ খাজা গরিব নেওয়াজ (রহঃ), শাহ জালাল (রহঃ), শাহ পরান (রহঃ), ৩৬০ আউলিয়া এবং চট্টগ্রামের বারো আউলিয়া সহ অসংখ্য সিংহপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে এই ভূখÐে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বেলায়তের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত, আধ্যাত্মিক সাধক, সত্যের প্রচারক, ওলী-এ কামেল, রাহনুমা-এ শরিয়ত ও তরিকত, আলে রাসূল, গাউসে জামান, আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহঃ)।
বাংলাদেশে শুভাগমন : আল্লাহ পাকের প্রিয় বান্দাগন এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকেন না। বরং দ্বীনের সার্থে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গমন করে পথহারা মানবজাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ অতিক্রম করে ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর প্রচার প্রসারে দেশ-বিদেশে গমনের মাধ্যমে মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে শুভাগমন করেন। ওই বছর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে খতমে তারাবির ইমামতি করেন। তার পবিত্র জবানে কুরআন তেলাওয়াত শুনে মুসল্লীরা মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে পিতার সাথে আবারো চট্টগ্রাম আগমন করলে আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাসায় অবস্থান করেন। তাঁর সম্মানিত পিতার ইন্তেকালের পর ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সফর করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এদেশে সফর করেন। এই মহান সাধকের নির্দেশনায় দেশ-বিদেশের বহু স্থানে আনজুমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বর্তমানে আনজুমানের অধীনে প্রায় ২৫৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যা আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে অকল্পনীয় ভূমিকা পালন করেছে।
পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ জশনে জুলুছ প্রতিষ্ঠা : চট্টগ্রামে পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ জশনে জুলুছ প্রতিষ্ঠা করে তিনি অমর হয়ে থাকবেন ইতিহাসে।
আল্লাহর বাণী- ‘আমার প্রদত্ত নেয়ামতের স্মরণ করো’ (আলে ইমরান-১০৩) রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। ১২ই রবিউল আউয়াল হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শুভাগমনের দিন। তাই এদিন সারা দুনিয়ার নবীপ্রেমিকের জন্য ঈদের দিন। ঈদ’ মানে খুশী আর ‘জশনে জুলুছ’ মানে বর্ণাঢ্য মিছিল। সুতরাং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল। জশনে জুলুছ একদিকে আল্লাহর মহান নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, অপরদিকে সেটা আল্লাহর নির্দেশ। নেয়ামতের স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যে প্রতিক হিসেবে সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালের ১২ই রবিউল আউয়াল হুজুর কেবলার নির্দেশে জশনে জুলুছের আয়োজন করা হয়। যা প্রতি বছর ৯ রবিউল আউয়াল ঢাকায় আর ১২ রবিউল আউয়াল চট্টগ্রামে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন করা হয়।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা : বর্তমানে বহুল আলোচিত ও সুপরিচিত একটি সংগঠন হলো ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’। যা আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের একক অঙ্গ সংগঠন। এটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংগঠন। ১৯৮৬ সালে আওলাদ-এ রাসূল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহঃ) সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সংগঠনের লক্ষ লক্ষ নিবেদিত প্রাণ পরীক্ষিত কর্মী রয়েছে। তারা নির্ভয়ে এগিয়ে চলছে সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে। করোনা মহামারি ও চট্টগ্রামের বিএম ডিপোর ভয়াবহ অগ্নিকাÐের সময় এই সংগঠনের কর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবতার সেবায় ঝাপিয়ে পড়ে। করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ গোসল, কাফন-দাফন, এ্যাম্বুলেন্স সেবা, অক্সিজেন সেবা, মেডিসিন সেবা সহ বন্যা দুর্গতদের পাশে সর্বদা সক্রিয় ছিলেন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। মানবতার সেবাই গাউসিয়া কমিটি’র মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য। এজন্যেই বিপদে আপদে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে দুয়ারে কড়া নাড়ে গাউসিয়া কমিটি। সারা দেশে ২৫ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত মোট দাফন সহায়তা দিয়েছে- ১০,০৯৬ জন। তন্মধ্যে শুধু চট্টগ্রামে ৫,৯৯৬ জন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ৬৫ জন। হিন্দু ৬০ জন। বৌদ্ধ ০৮ জন। খ্রিষ্টান ০১ জন। অজ্ঞাত লাশ ৭৯ জন। ফ্রি অক্সিজেন সেবা ৪২,৬২১ জন। ফ্রি এ্যাম্বুলেন্স সেবা ১১,৩৩৭ জন।
বর্তমানেও গাউসিয়া কমিটি’র মানবিক সেবার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইনশাআল্লাহ! ভবিষ্যতেও আধ্যাত্মিক প্রেরণা নিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে কাল থেকে কালান্তরে সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ।

লেখক : খতিব- বায়তুল আমান জামে মসজিদ বন্দর চট্টগ্রাম