জলাবদ্ধতা নিরসনে সুইচ গেট সমাধান নয় নগরবাসীর দুঃখ মুছবে কখন ?

9

ঘুরেফিরে আবারও সেই আগের কথাই, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সুইচগেট কোন কাজ দিবে না। ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রামের উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে জড়িত এমন স্থপতি ও বিশেষজ্ঞরা নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৬ খালের সংস্কার এবং ২৪ টি খালের কর্ণফুলীর সঙ্গমস্থলে ৪০টি সুইচগেট নির্মাণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার বিরোধিতা করে এ ধরনের উদ্যোগকে আত্মঘাতী বলেছিলেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের সেই মতামত আমলে নেয়া হয়নি, প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে; সব ক’টি সুইচগেট নির্মাণও শেষ হয়েছে কিন্তু এখনও সেই আগের কথাই আসছে জলাবদ্ধতা নিরসনে খালের মুখ ছোট করে গেইট নির্মাণে নগরবাসী কোন সুফল পাবে না। বরং জোয়ারের পানি আর বর্ষায় বৃষ্টির পানি একসাথে হলে চট্টগ্রামের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনার সম্ভাবনাই বেশি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সুইচগেইট খুলে দেয়া হয়, তবে জোয়ারের পানিতে আগের চেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রাম নগরী। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বাসি কথা দেরি হলেও ফলে। ধরে নেয়া যায়, চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে সহজে মুক্তি পাচ্ছে না! গত রবিবার চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে আয়োজিত একটি সেমিনারে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ তার বক্তব্যে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে খালের মুখ ছোট করে যে সুইচগেট নির্মাণ করা হচ্ছে তার তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, খালগুলোর মুখ ছোট করে দিয়ে সুইচ করে দিলেন, জলাবদ্ধতা তো হবেই। সব জায়গায় প্রমাণিত হয়েছে এটা সুইচগেইট কোনো কাজের না। প্রকৃতিকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। নদীর জীবন সত্তা আছে। তাকে গলা টিপে ধরলে হবে না। তিনি ‘কর্ণফুলী নদী রক্ষা করা না গেলে চট্টগ্রামের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে’ বলে মন্তব্য করে বলেছেন, চাক্তাই খাল সার্ভে করে আর এস দাগ অনুসারে উচ্ছেদ করতে হবে। এসময় তিনি এ সংক্রান্ত মামলার রায় কয়েকদিনের মধ্যে আসবে বলে সেমিনারে জানান। এ সেমিনারের দুই বছর আগে নগরীতে আরো একটি সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা একই মত পোষণ করেছিলেন। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে ‘বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদী, খাল ও জলাশয় রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা। সেই সময় বিশিষ্টজন যেসব পরামর্শ দিয়েছিলেন তা গুরুত্বে সাথে প্রকাশ করেছিল স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম। এসময় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৩টি খালের মুখসহ পুরো এলাকায় ৪০টি সুইচগেট নির্মাণের পরিকল্পনাকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মত দিয়েছিলেন নদী গবেষক ও আলোচকেরা। সেদিন তারা বলেছিলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায় কর্ণফুলী নদীতে পড়া ২৩টি, হালদায় তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে পড়া ১৪টি খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণ ও চাক্তাই, রাজাখালী ও মহেশ খালে সুইচ গেট নির্মাণ একটি আত্মঘাতী পরিকল্পনা। নদীতে জোয়ারের সময় সুইচ গেট বন্ধ থাকবে তখন নগরীতে ১০০ মিলি লিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হলে অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। সুইচগেট নির্মাণ করে খালকে চিরতরে হত্যা করা হবে। উক্ত আলোচনায় একজন সাংবাদিক তার বক্তব্যে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪০টি সুইচগেট নির্মাণ করা হচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, ভবদহে কৃষকরা সুইচগেট ভেঙে ফেলার কথা বলছেন। চট্টগ্রামেও যদি সুইচগেটগুলো পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কি খালগুলো বাঁচবে?’ বলাবাহুল্য যে, জলাবন্ধতা দূর করতে গত ১৪ বছরে শুধু চাক্তাই খালে ৩২৪ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যা প্রতিবছর গড়ে ২৩ কোটি টাকা। কিন্তু চাক্তাই খাল আগের মতোই রয়ে গেছে। ১৯৬৯ সালে ফ্লাড ডিটেইল প্ল্যান অনুযায়ী নগরীর ৭১টি খাল আর এস সিট অনুযায়ী উদ্ধার না করা হলে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়। আমরা লক্ষ্য করছি, আজ থেকে ১৫ বছর আগে প্রায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ হিসেবে চাক্তাই খালের তলা পাকা করা হয়েছিল, কিন্তু এটি চাক্তাই খাল দখল ও ভরাটে ভযাবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে চাক্তাই খালের পাকা তলা ভেঙ্গে ফেলা হবে। আমাদের আশঙ্কা আর কয়েকবছর পর হাজার কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অবস্থাও কাই হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার আগে বারবার প্রকল্প সঠিক এভাবে বাস্তবসম্মতভাবে নেয়া হয়েছে কিনা, ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করা হয়েছে কিনা, তা ভালোভাবে যাচাইবাছাই করার তাগিদ দিয়ে আসছেন। কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীতে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আমরা আশা করি, সময় এখনও আছে, প্রকল্পের কাজ চলমান। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ প্যানেল করে কাজের মান যাচাইসহ বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করা জরুরি।