জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ধস রোধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন

26

আষাঢ়ে গল্পের ন্যায় প্রতিবছর বর্ষা আসলেই সংবাদপত্রে চট্টগ্রামে পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতার কাহিনী লিখতে হয়। আর নগর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন ব্যর্থ অভিযানের বিশাল এক প্রস্তুতি নিয়ে ঢামাঢোল বাজিয়ে পাহাড় আর নগর রক্ষায় বের হন। সর্বশেষ আবারও নিস্ফল অভিযান ইতিহাসের খাতায় লেখা হয়, আরেকটি আষাঢ়ে গল্পের পয়দা হয়। পাহাড় ধস হতে থাকে, মধ্যস্বত্তভোগীদের আশ্রয়ে পাহাড়ে বসাবাসরত অসহায় মানুষগুলো মরতে থাকে, নগরী ডুবতে থাকে আর নগরবাসী হা-হুতাশে মত্ত থাকে। এবারও তার ব্যত্যয় হবে বলে মনে হয় না। গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উল্লেখিত বর্ণনা অন্তত তাই মনে হচ্ছে। প্রতিবেদনে আবহাওয়া অফিস সূত্রে উল্লেখ করা হয় যে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সারাদেশে বিস্তার লাভ করায় প্রায় সব বিভাগেই কমবেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ু নিজের শক্তিমত্তার ধরন পাল্টে প্রবল অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। তার প্রভাবে বুধবার একদিনেই সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারে রেকর্ড সর্বোচ্চ তিনশ’ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির এই দাপট আগামী কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণেরও আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ভারী বর্ষণজনিত কারণে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূমিধসের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মৌসুমি বায়ু প্রবেশের সাথে সাথে গত ১১ জুন থেকে দেশে বৃষ্টিবলয় চালু হতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বৃষ্টিবলয় আগামী ২৭ জুন পর্যন্ত চালু থাকতে পারে। মৌসুমি বৃষ্টিবলয়ে সাধারণত একটানা বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আবহাওয়ার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বৃষ্টিবলয় চট্টগ্রাম হয়ে ধারাবাহিকভাবে রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেই মৌসুমি বায়ুর এ নেতিবাচক প্রভাব আমাদের জন্য সূখকর নয়। চট্টগ্রাম এমনিতেই করোনা আতঙ্কের হটস্পট হয়ে আছে। রাজধানী ঢাকার পরই এ চট্টগ্রাম করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বেশি। এ অবস্থায় বর্র্ষার অতি বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধস ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে চরম ভোগান্তিতে পড়বে চট্টগ্রাম ও শহরবাসী। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকাও থমকে দাঁড়াবে। গত ১২ মার্চ চট্টগ্রাম ওয়াল্ড থ্রেড সেন্টারে আয়োজিত ‘ইকোনমিক ইমপেক্ট অব ওয়াটারলগিং ইন লোকাল ট্রেড: এ স্ট্যাডি ইন খাতুনগঞ্জ, চট্টগ্রাম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর রিস্ক প্রোফাইল ফর চট্টগ্রাম’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. নূরুল আমিন চট্টগ্রামে পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতা এখনো দুর্যোগ হিসেবে রয়ে গেছে বলে মত দিয়ে বলেন, এর ফলে শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কারণ চট্টগ্রাম দেশের অন্যতম প্রধান অর্থনেতিক চালিকা শক্তি। তিনি এ অবস্থা থেকে উত্তরণে মাস্টারপ্ল্যান যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার উপর জোর দেন। এসময় চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সরকার রাজস্ব হারায়। চাক্তাই খাল, রাজাখালী খালসহ সংশ্লিষ্ট খালগুলোর মুখ ভরাট হওয়ার কারণে জোয়ার ও বৃষ্টির পানি আটকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রাখার গুদামগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তবে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। এছাড়া কর্মশালায় বক্তারা চট্টগ্রামে বেদখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার, নদীর পাড় উন্নয়ন করে পর্যটন প্রসার, সিটি গভর্ন্যান্স চালু, অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ, প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষা, উন্নয়ন কার্যক্রমে ডিজিটাল ম্যাপ ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত, বিভিন্ন খাল উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্থ ছিন্নমূল মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা, ভূমিধস বন্ধে পরিকল্পনা গ্রহণ, এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করা, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বার্জের মাধ্যমে খাতুনগঞ্জ এলাকায় পণ্য পরিবহন, জাইকা স্ট্যাডি অনুযায়ী রিং রোড বাস্তবায়ন, নালা ও খালে বর্জ্য নিক্ষেপের ক্ষেত্রে জনগণের আচরণ পরিবর্তন করা এবং দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানান। আমরা মনে করি, কর্মশালার সামগ্রিক আলোচনা চট্টগ্রামের অর্থনেতিক প্রবাহে প্রধান বাধা হিসাবে উঠে এসেছে জলাবদ্ধতা ও ভূমি ধসের কথা। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, পাহাড় ধসে প্রাণহানি-ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রশাসনের কিছু তৎপরতা এবং জলাবদ্ধতার সংকট নিরসনে বড় আকারে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও পাহাড় ধস ঠেকানোর ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনে সরকারের শীর্ষ মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এর কোনো বিকল্প নেই।