জলাবদ্ধতা এবারও নির্বাচনী ‘ট্রাম্পকার্ড’

65

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের ইশতিহারের প্রথমদিকেই থাকে জলাবদ্ধতা নিরসনের আশ্বাস। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনী বিজয়ী প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিনও একই অঙ্গীকার করেছিলেন। অঙ্গীকার করে আসছিলেন বর্তমান মেয়রের পূর্বসূরীরাও। তবে কেউ কথা রাখতে পারেননি। ভারী বর্ষণে বরাবরই অথৈ পানিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম শহর। এবার জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সিডিএ’র অধীনে প্রকল্পটির কাজ চলমান থাকায় একপ্রকার দায়মুক্তি পেয়েছে চসিক। যে কারণে গত চারদিনের টানা বর্ষণে চট্টগ্রামের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হলে দুর্ভোগে পড়া নগরবাসীর সমালোচনার তীর ছিল সিডিএমুখি।
জলাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনায় মেতে ওঠা নগরবাসী অপরিকল্পিত উন্নয়নকেই দোষারোপ করছেন বেশি। একইভাবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়হীনতায় কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের সুফল মিলছে না। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের একক সিদ্ধান্তের কারণেই নগরবাসীকে চলতি বর্ষাতেও জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পর্ষদ সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, এরকম হবে আমরা আগেই বলেছিলাম। এতদিন বৃষ্টি হয়নি তাই সমস্যা হয়নি, বৃষ্টি হয়েছে সমস্যা ও হয়েছে। এটা দীর্ঘদিনের অবহেলার পুঞ্জিভূত সমস্যা। তবে সমাধানযোগ্য। এখনো বেশকিছু প্রকল্প চালু আছে। সিডিএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান গত বর্ষায় বলেছিলেন এবার ফলাফল পাওয়া যাবে। আমরা তা পাইনি। চলতি বর্ষাতেও কাক্সিক্ষত কোনো ফলাফল নাই। তিন বছরের মধ্যে দুই বছর অতিক্রম হয়েছে। এখনো পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
তিনি বলেন, এ প্রকল্প নিয়ে সমন্বয়হীনতা তৈরি করেছে সরকার। সিটি কর্পোরেশনের একটি প্রকল্প ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে প্রি-একনেক শেষ করে একনেক পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তারপরে সেটাকে ডিঙিয়ে সিডিএকে একটি অপ্রস্তুত প্রকল্পের উপরে বড় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থা এবং এ কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকাতেই শেষপর্যন্ত তারা সেনাবাহিনীর ধারস্থ হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষে রক্ষণাবেক্ষণ কারা করবে তা নিয়ে পরবর্তী কোনো দিকনির্দেশনা নেই। যে কারণে আমরা আতঙ্কিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় একের পর এক যেসব প্রকল্প দিচ্ছেন সেসব প্রকল্পের অপচয় হচ্ছে কিনা তা নিয়ে আমরা উদ্বিঘœ।
প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সর্বশেষ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ মে শপথ নেন নির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। সে হিসেবে পরবর্তী চসিক নির্বাচনের সময় আর বেশি বাকি নেই। স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিন আগেই নির্বাচন করতে হবে। আগামী ডিসেম্বরেই চসিক নির্বাচনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আসন্ন চসিক নির্বাচনে বরাবরের মতো এবারো আলোচনায় থাকবে নগরের জলাবদ্ধতা। বর্ষা মৌসুমে নগরবাসীর দুর্ভোগের অন্যতম কারণ এই জলাবদ্ধতা নিয়েই প্রার্থীদের কাছে ভোটারদের আকাঙ্খা থাকবে বেশি। সিডিএ কর্তৃক প্রকল্প বাস্তবায়নে চসিক দায়মুক্তি পেলেও ভোটারদের দাবির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন মেয়র প্রার্থীরা। নির্বাচনী মাঠে মেয়র পদে যারাই প্রার্থী হবেন তাদের জলাবদ্ধতা ইস্যুতে ভোটারদের মুখোমুখি হতে হবে।
পশ্চিম বাকলিয়ার বাসিন্দা হারুন উর রশিদ পূর্বদেশকে বলেন, সিডিএ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু যার হাত ধরে প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে তিনি নিজেই সিডিএতে নেই। তার উপর প্রকল্পের অগ্রগতিও নেই। জলাবদ্ধতা ইস্যুটি বরাবরের মতো এবারো চসিক নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। যদিও জলাবদ্ধতার জন্য এবার সিডিএকেই বেশি দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু ভোটের সময় মানুষের দুয়ারে যাবেন চসিক মেয়র। নতুন কিংবা পুরানো হোক জলাবদ্ধতার বিষয়ে ভোটারদের তোপের মুখে পড়বেন মেয়র প্রার্থীরাই।
টিআইবি সদস্য দেলোয়ার হোসেন মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, জলাবদ্ধতা আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পকার্ড হবে না। কারণ, জলাবদ্ধতার দায়িত্ব এখন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপরে। তবে জলাবদ্ধতা বিষয়টি যেহেতু একটি বড় সমস্যা, স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনে আসলে তা আলোচিত হবে। সবাই আশা করবে মেয়র একটি ভূমিকা নিবেন। অতীতের মেয়ররা যেভাবে এটা নিয়ে কঠিন অবস্থায় পড়েছেন বর্তমান মেয়র এ সমস্যায় পড়বেন না। যেহেতু দায়টা উনার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে সরকার সিডিএ’র ঘাঁড়ে ন্যস্ত করেছে।
মেয়র যা বললেন :
সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পূর্বদেশকে বলেন, জলাবদ্ধতা হঠাৎ সৃষ্ট কোনো সমস্যা না। এটি দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা। মিডিয়া বেশি সচেতন ও সোচ্চার বলেই জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি সেদিকে ধাবিত হয়েছে। আমি যেদিন দায়িত্ব নিয়েছি সেদিনই প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতা ও জলজট ভিন্ন বিষয়। মিডিয়ার কারণেই এটি জলাবদ্ধতা হিসেবে পপুলার হয়েছে। একেক অঞ্চলে পানি একেক কারণে উঠে। অনেক সেনসেটিভ জায়গায় পানির ড্রেন বন্ধ আছে।
সিটি মেয়র বলেন, কর্পোরেশনের রেগুলার কাজের মধ্যদিয়ে জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব না। এখানে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। আমি একটি প্রকল্প নিয়ে এমইউ করেছিলাম। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করেছিলাম। অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হুট করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের রেগুলার কাজ না হলেও সিটি কর্পোরেশনের সাথে কোনোরূপ আলোচনা না করে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু করে। ওরা কোনো স্ট্যাডি না করে প্রকল্প একনেকে নিয়ে যায়। সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ নিয়ে একনেক সভাতেই প্রশ্ন উঠে। এরপরেও প্রকল্পটি পাস হয়েছে। পরে দুই বছর যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। এবার যেভাবে পানি উঠেছে দেখা যাচ্ছে গত দুই বছর সেভাবে পানি উঠেনি। এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কথা তুলে ধরে মেয়র নাছির বলেন, দুর্ভোগ হলে কিছু দোষ সরকারের উপর পড়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্প বাস্তবায়নে খুব বেশি আন্তরিক। কি কারণে তিনি (আবদুচ ছালাম) এ কাজটি করেছেন তিনিই ভালো জানবেন। হয়তো দেখা যাবে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যই এভাবে করেছেন। কোনো বিশেষজ্ঞ এ প্রকল্পের পক্ষে কথা বলছেন না।
আগামী চসিক নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নে মেয়র বলেন, জনগণ আমার কাছে আসতেই পারে। কারো কাছে আলাদীনের চেরাগ নাই। সরকার যতটুকু চাইবে ততটুকুই হবে। এখন প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কেউ রাতারাতি শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন করতে পারবেন না। অনেকেই তা মনে করেছে বলেই আজকে সমালোচনা বেড়েছে। সব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরই বুঝা যাবে প্রকৃতপক্ষে সুফল কেমন আসছে। তবে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে এবং সমীক্ষার মাধ্যমে যদি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় অবশ্যই সুফল মিলবে।
সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান যা বললেন :
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম নিজের ফেসবুক পেজে জলাবদ্ধতা নিয়ে মতামত তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘদিনের জটিল সমস্যা যা বহু বছর যাবৎ চট্টগ্রামবাসীকে কষ্ট দিচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিল সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে সরকারি অনুমোদন। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে অত্যন্ত সীমিত আকারে কিছু নিত্য-নৈমিত্তিক কাজের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয় যুগের পর যুগ। প্রথমে উচিত ছিল জলাবদ্ধতার কারণসমূহ চিহ্নিত করা এবং প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের অনুমোদন নিয়ে তা সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই কাজটি করার জন্য অতীতে কেউ সাহস করে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
জলাবদ্ধতার পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি সমস্যা সমাধানে আট হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়ার মত দুঃসাহসিক উদ্যোগ কোনো সরকার, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি গ্রহণ করেছে বলে নজির নাই। চলমান প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণভাবে সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত জনগণ তার সুফল পায় না বরঞ্চ প্রকল্পের কাজ চলমান থাকা অবস্থায় জনগণের দুর্ভোগ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেড়ে যায় এবং এটাই স্বাভাবিক। তাই প্রকল্পসমূহের কাজ পুরোপুরি সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। চসিক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্ণফুলী ড্রেজিংসহ চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত জলাবদ্ধতা সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান আশা করা উচিৎ হবে না।