জলবায়ু সমস্যা ও সম্ভাব্য প্রতিকার প্রসঙ্গে

41

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

বিশ্বের সকল সচেতন মহলের ধারণায় গভীরভাবে প্রোথিত যে করোনা অতিমারির চেয়েও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভয়াবহ থেকে ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করতে যাচ্ছে। মনন-জ্ঞাননিরপেক্ষ কোন ব্যাখ্যা নয়; প্রায়োগিক বিজ্ঞানসম্মত গুণগত বিশ্লেষণে প্রতিফলিত পরিবেশ দূষণ-জলবায়ু পরিবর্তনের যৌগিক মিথস্ক্রিয়া বিশ্ববাসীর জীবন-জীবিকার গতিশীল ধারার রুদ্ধতাকে কতটুকু বিপর্যস্ত করবে তা সহজে অনুমেয়। পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। বাচনিক কোনো আলাপ-আলোচনা-সম্মেলন-প্রস্তাব গ্রহণ বর্জনের অমূলক চিন্তাধারা সংহার করে দ্রæততার সাথে অর্থবহ কর্মকৌশলের যথার্থ বাস্তবায়ন অপরিহার্য। অন্যথায় বিশ্ব বিধ্বংসী এই সুনামি থেকে মানব জাতিকে আড়াল করার কোনো পন্থাই বিকল্প হতে পারে না। বিশ্বব্যাপী অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করা হচ্ছে। দীর্ঘ দিন যাবৎ জলবায়ু পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বের সমস্যা হলেও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলো এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীলদেশসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে প্রচন্ড লন্ডভন্ড। বর্তমানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহসহ যাবতীয় উন্নয়ন উদ্যোগ তথা দারিদ্র দূরীকরণ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাষণ ও জনস্বাস্থ্য, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আর্তনাদে নিপতিত হয়েছে গরীব ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলো। বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এ্যাকশন প্ল্যান-এ জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়কে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ এর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গেøাবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাবে প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সঙ্কটকে আরোও বেশি জোরালো করছে। পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াও উপকূলের অনেক এলাকার প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রতীয়মান। মাত্রাতিরিক্ত গরম জলবায়ু পরিবর্তনের অন্য ধরণের প্রভাব। এতে ফসলী জমি নষ্ট হয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা সঙ্কটাপন্ন হচ্ছে। প্রতি পাঁচ বছরে একবার খরার কারণে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণায় দেশের উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশলীতা ব্যাপক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত ৫০ বছরে (১৯৬৮-২০১৮) দেশে দিনে ও রাতে উষ্ণতার হার বেড়েছে। একইভাবে দিন ও রাতের শীতলতা ভীষণ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ দশকে উষ্ণ দিনের সংখ্যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় প্রতিবছরে শূন্য দশমিক ৩৯৪ দিন এবং দেশের অভ্যন্তরভাগে শূন্য দশমিক ১৫ দিন করে বেড়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর উষ্ণ দিনের সময়ও শূন্য দশমিক ৫০৭ দিন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত দুই দশক যাবৎ বজ্রপাত বাংলাদেশে নতুন দুর্যোগ হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে বজ্রপাত সম্পর্কিত গবেষণা অনুসারে বিশ্বের সর্বত্র বজ্রপাত সমহারে বাড়ছে না, তবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বজ্রপাতের উপর উষ্ণায়নের প্রভাব সুস্পষ্ট। অর্থাৎ, সারা বিশ্বে না বাড়লেও দক্ষিণ এশিয়া বা ক্রান্তীয় অঞ্চলের অনেক দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। গণমাধ্যম সূত্রমতে ২০১৩-২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৮ জন যাঁদের ৭২ শতাংশই কৃষক। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে এটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ’ প্রতিবেদনে অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত ঝুঁকির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে শীর্ষে দেখানো হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে বছরে প্রতি লাখে প্রায় ৩৩ জন মারা যাচ্ছে। জলোচ্ছাস বা সাইক্লোন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জন্য নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনে এর তীব্রতা ও সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রæতিতে বঙ্গোপসাগর ক্রমইে উত্তাল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, ৭ জানুয়ারি ২০০৮ থেকে ১০ নভেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত সাগরে ৬টি জল-ঘূর্ণিঝড় এবং ১০৭টি লঘু ও নি¤œচাপ সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্র দিনে দিনে বিক্ষুব্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০০৯ সালের ১২ থেকে ২১ জুলাই টানা নয় দিন চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এবং কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে হয়েছিল। এ সময় কোনো জেলের পক্ষে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। জলোচ্ছাসের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি উপকূলীয় এলাকার স্বাদু পানিকে লোনা করে দেয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং এর গবেষণা মতে, বাংলাদেশের উপকূলের ১৪টি শহর জলোচ্ছাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী ‘ল্যানসেট’ তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনায় বলেছে; সংক্রমণ ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ধরণে পরিবর্তন আসবে, তাপপ্রবাহে মৃত্রের সংখ্যা বাড়বে, জলোচ্ছাস-ঘূর্ণিঝড়-কালবৈশাখী ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি জখমের সংখ্যাও বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানারকম স্বাস্থ্যঝূঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। শ্বাসকষ্ট, হীটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠান্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি এখন সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ এর গবেষণায় মতে জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ডায়রিয়ার জীবাণুর বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে এবং ডায়রিয়ায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে। অ্যাকশন এইড-এর পক্ষ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র থেকে ভূভাগের অনেক ভিতর পর্যন্ত লোনাপানি ঢুকে পড়ায় লোকজনকে পানি ও খাবারের সাথে তুলনামূলক বেশি পরিমাণ লবন গ্রহণ করতে হচ্ছে। এতে ঐ এলাকার লোকজন উচ্চ রক্তচাপ রোগে ভোগার সম্ভবনা বাড়ছে।
জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের পানিসম্পদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ সমুদ্রতীরের বেশ কয়টি দেশে ভবিষ্যতে মিঠা পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেবে। কালক্রমে এ সমস্যা ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করবে। ইতিমধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় অনেক এলাকায় সুপেয় পানির অভাব প্রতীয়মান হয়েছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এই প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। শীতলতা বজায় রাখতে অতিরিক্ত পানির ব্যবহার অদূর ভবিষ্যতে পানিসম্পদের উপর চাপ বাড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২৯ সালে দেশের নগরের জনসংখ্যা হবে ৮১ দশমিক ৪ মিলিয়ন। বাংলাদেশ হবে অন্যতম নগর রাষ্ট্র। তাই নগরের উষ্ণতাকে আমলে না নিলে দেশের বড় নগরগুলোর সমস্যা দিন দিন জটিল হয়ে বাসযোগ্যতা হারাতে পারে। মৃত্তিকাসম্পদ ও গবেষণা কেন্দ্রের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্যমতে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ নদীর পানি লোনা হতে থাকে। ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে তা পুরোপুরি লোনা হয়ে যায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যম তথ্যসূত্র পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে বিশ্বে সর্বনি¤œ হওয়া সত্তে¡ও এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে। মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮.৫, জাপানের ৯.৫, মালয়েশিয়ার ৭.৭, ভারতের ০.৮ টনের বিপরীতে বাংলাদেশের নিঃসরণ মাত্র ০.৩ টন। গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ক্ষতিকর প্রভাবও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। ইন্টার গভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’র (আইপিসিসি) ৪র্থ সমীক্ষা অনুসারে, গত শতাব্দীতে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৭৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ যা ২.৫০ থেকে ৩.৫০ সেলসিয়াসে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সাধারণত মধ্য প্রাচ্য এবং উপসাগরীয় অঞ্চলেই তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। কিন্তু এই গ্রীষ্মকালে ইতালি ও কানাডায় যথাক্রমে ৪৮ দশমিক ৮ ও ৪৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হওয়ার পর পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার না কমালে বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল চেইঞ্জ ইন্সটিটিউটের সহযোগী পরিচালক তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রবণতার কারণ হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানির অধিকতর ব্যবহারকে শতভাগ দায়ী করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ১৯৮৫-১৯৯৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা ১০ সেলসিয়াস এবং নভেম্বর মাসে ০.৫০ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।
উল্লেখ্য সমীক্ষার বিশ্লেষণে প্রতিফলিত হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও বৃদ্ধি পায় তাহলে মাটি-পানির ইকোসিস্টেম এবং বায়ুমন্ডল মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে। মাটির অনুজীবের কার্যাবলী, আয়ন বিনিময়, পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা, মাটির পানি চলাচল, মাটির অ¤øতা, জৈব পদার্থের পচন, শিকড়ের বৃদ্ধি বিঘিœত হয়ে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাবে। সাধারণত বাংলাদেশে উৎপাদিত ফসলের ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয় অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে। উক্ত সময়ে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে প্রায় সব ফসলেরই ফলন কমে যাবে। পক্ষান্তরে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির ধান ও বর্ষাকালীন ফসলের উৎপাদনও ব্যাহত হবে। আকস্মিক বন্যায় হাওর এলাকাসহ উপকূল, মোহনা ও নদী অববাহিকার ইকোসিস্টেম ও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। ২০৩০ সালে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০-১৫ শতাংশ এবং ২০৭৫ সাল নাগাদ ২৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কৃষিতে চ্যালেঞ্জসমূহ আরও জটিল হবে। যদিও শস্যদানা উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ তথাপি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিজ্ঞজনের ধারণা মতে, ২০৫০ সালে বর্তমানের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি খাদ্য লাগবে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশকে কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে।
প্রাসঙ্গিকতায় ১ নভেম্বর ২০২১ স্কটল্যান্ডের গøাসগোয় অনুষ্ঠিত ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৬) মূল অধিবেশনে বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন হ্রাস করার জন্য প্রধান নির্গমনকারীদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা (এনডিসি) পেশ এবং সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর প্রতি উদাত্ত আহŸান জানান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। উক্ত অধিবেশনের ভাষণে তিনি চারটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে- ধনী দেশগুলোর কার্বন নি:সরণ কমানোর ওপর জোর দেওয়া, উন্নত দেশগুলোর উচিত অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে ৫০ ঃ ৫০ ভারসাম্য রেখে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রæতি পূরণ করা, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে পরিচ্ছন্ন-সবুজ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া ও সিভিএফ দেশগুলোর উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙ্গন, বন্যা-খরার কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়বদ্ধতা ভাগ করে নেওয়াসহ লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সমাধান করা। এসময় তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় তাঁর সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ সমূহ বিশ্বনেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরেন। যার মধ্যে রয়েছে- দেশের এনডিসি আপডেট, ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশী বিনিয়োগে ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল এবং ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিজস্ব শক্তির ৪০ শতাংশ নেওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ চালুকরণ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করে দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে উপকূলীয় এলাকায় বহু ভবন নির্মাণ করায় দুর্যোগে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও উপার্জন হারানোর হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভার মোকাবেলা সংক্রান্ত কর্মকাÐে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে বার্ষিক বরাদ্দের ৬ থেকে ৭ শতাংশ ব্যয় করছে। বছরে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০০ কোটি ডলারের সমান। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই পরিবেশের অনুষঙ্গগুলো অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় সরকার কর্তৃক ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা ২০০৯’ চূড়ান্ত করা হয়। বর্ণিত এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী উন্নত দেশের অর্থ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরণের তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম যা আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বিশেষভাবে প্রসংশিত হয়েছে। উল্লেখিত কর্মযজ্ঞ একদিকে আশাজাগানিয়া পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিচ্ছে; অন্যদিকে সংবাদ মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রে দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন নির্মাণাধীন বাঁধ-কালভার্ট-ব্রিজ-আবাসন-নানাবিধ উদ্যোগগুলো অস্বাভাবিক অনিময়-দুর্নীতি-শূন্য পর্যবেক্ষণ-চরম অবজ্ঞার ফলশ্রæতিতে কীভাবে কতটুকু কদর্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হচ্ছে তার সঠিক পরিমাপও অত্যন্ত জরুরী। এর ব্যতিক্রম হলে অর্থ-সময়-সম্পদ-লোকবল ইত্যাদির সামষ্টিক অপচয় যেন বাংলাদেশের ললাটে কলঙ্ক তিলক না হয় সেদিকে সরকার-জনপ্রতিনিধি-জনগণের সতর্ক দৃষ্টি-মনোযোগ আকর্ষণ প্রত্যাশা করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি