জলবায়ু পরিবর্তনে শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে

6

 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের সবচাইতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি ঝুঁকি তৈরি করছে। তারা তাদের শিশুদের পর্যাপ্ত খেতে দিতে পারছে না, তাদের সুস্থ রাখতে পারছে না। তাদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। একটি প্রতিবেদনে বলছে, খরা বা সাইক্লোনের মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির অর্থ হল এতে আক্রান্ত পরিবারগুলো আরও বেশি দরিদ্র হওয়া। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত পরিবারগুলো যখন ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, তখন সেই পরিবারের শিশুরা অর্থ উপার্জনের জন্য কোন কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে শিশুদের নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে বলে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দায়িত্ব নিতে না পেরে মেয়ে শিশুদের অনেক পরিবার দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, সারা দেশে বিশটি জেলার শিশুরা সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত অনেক পরিবার নিজের এলাকায় সর্বস্ব হারিয়ে এক পর্যায়ে কাজের খোঁজে শহরে চলে আসছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, সারা বিশ্বের মোট শিশুর অর্ধেকের জীবনই দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
তাপদাহ, বন্যা, সাইক্লোন, দুরারোগ্য ব্যাধি, খরা আর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের প্রতিটা শিশুই ঝুঁকির মুখে পড়বে। কিন্তু বিশ্বের ৩৩টি দেশে থাকা অন্তত ১০০ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তনে খুব বেশি ভয়াবহতার শিকার হবে। এর মধ্যে ভারত, নাইজেরিয়া, ফিলিপিন্স ছাড়াও সাব সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দারিদ্র্য বাড়ছে, শিশুরা সুপেয় পানি পাচ্ছে না, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, শিক্ষার পরিবেশ থাকছে না। শিশুরা যেন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা মোকাবিলা করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে আমাদেরই। জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে ১০টি দেশে, যে দেশগুলো সারাবিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের জন্য দায়ী। অন্তত ৯২ কোটি শিশু বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়বে। ৮২ কোটি শিশু তাপদাহের শিকার হবে, ৬০ কোটি শিশু ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগে ভুগবে। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মশার উপদ্রব বাড়ছেই।ইউনিসেফের পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান আর ভারতের শিশুদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়বে। কারণ দেশগুলোতে দূষণের পরিমাণ অনেক বাড়ছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা ও নদীভাঙনের মতো নানা দুর্যোগের প্রতিক‚ল প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের শিশুদের ওপর। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়া অত্যন্ত উচ্চঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এই সংস্থাটির প্রতিবেদনটির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ছাড়াও উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরও তিনটি দেশ আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তান। এতে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর শিশুরা দাবদাহ ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে আছে। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রেও হুমকির মধ্যে আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলা হয়েছে বৈশ্বিক পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৫টি দেশের মধ্যে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাও। তবে দেশ দুটির অবস্থান অনেকটা ভালো। ইউনিসেফের সুচকে ৬৫টি দেশের মধ্যে নেপালের অবস্থান ৫১তম এবং শ্রীলঙ্কা অবস্থান ৬১তম। তবে সূচকের তালিকায় পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারতের অবস্থান যথাক্রমে ১৪, ১৫, ১৫ ও ২৬ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভুটান, সুচকে যার অবস্থান ১১১তম এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশটির শিশুরা অপেক্ষাকৃত অনেক কম ঝুঁকিতে আছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক বলেন, প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার লাখো শিশুর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ুদূষণ ও নদীভাঙনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় আছে বলে উল্লেখ করে তিনি। বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনা মহামারি মিলে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সংকট তৈরি করেছে। জর্জ লারিয়া আদজেই মনে করেন, পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে পরিবর্তনশীল জলবায়ু এবং ক্রমেই খারাপের দিকে যাওয়া পরিবেশের প্রভাব থেকে শিশুদের ভবিষ্যতকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব উপক‚লীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি মারাত্মক। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি আমরা যদি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, তবেই সম্ভব সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিশুসহ সবার নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, সাহিত্যিক