জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহকে তৎপর হতে হবে

18

 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত ও ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি মৌসুমী আবহাওয়ার পরিবর্তন, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, সমুদ্রে জোয়ার ও উষ্ণতা বৃদ্ধি, বজ্রপাতসহ জলোচ্ছ¡াস ইত্যাদি জরবাযুর নেতিবাচক প্রভাবের ফল হিসাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এর বাইরে আরো উদ্বেগজনক খবর দিয়েছে স্বয়ং সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে প্রণীত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে প্রতি সাতজনে একজনের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে অন্তত ১ কোটি ৩০ লাখে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে গভীর চিন্তা ও শঙ্কার। উল্লেখ্য, আগামী নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ুবিষয়ক ‘কনফারেন্স অব পার্টিস’ সংক্ষেপে কোপ-২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে এবং এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এছাড়া গত সপ্তাহে এক ওয়েবিনারে বিশ্বব্যাংক ‘জলবায়ুর দুর্ভোগ’ বা ‘ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে জনগণের স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের নতুন প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। একই কারণে দেশবাসীর মধ্যে বিষাদ ও উদ্বেগ বাড়ছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সংকট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে এখন থেকে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রকৃতিতে যে ঋতুবৈচিত্র্য তা লোপ পাচ্ছে। এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর যে পার্থক্য তা মুছে যাচ্ছে। আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়ছে। এতে শহর এলাকায় ডেঙ্গুর মতো বাহকনির্ভর রোগের প্রকোপ বাড়ছে। গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশবিরোধী নানারকম কর্মকাÐের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসগুলোর উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বায়ুমÐলের নিচের স্তরে উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে তা প্রভাবিত করছে পৃথিবীর জলবায়ুকে। বিশেষ করে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তনগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানারকমের স্বাস্থ্যসমস্যা ডেকে আনছে। গত দুই দশকে জলবায়ুর প্রভাবে দেশে দুর্যোগের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত চারগুণ। এটি আমাদের মতো কৃষিপ্রধান ও অধিক জনসংখ্যার দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখতে এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে উন্নত দেশগুলোর তাৎক্ষণিক ও উচ্চাভিলাষী অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণ করা জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে আমরা শুনে আসছি, সংকট সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত কৌশল প্রণয়নের কথা। কিন্তু বাস্তবসম্মত কোন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে কিনা, তা এখনও দৃশ্যমান নয়, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশের কী করা উচিত, বিশ্বের কী করা উচিত। এ বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে সহায়তার জন্য প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০। এটি অত্যন্ত তথ্যবহুল ও বিজ্ঞানভিত্তিক একটি পরিকল্পনা, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর উচিত এ ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে কাজ করা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবিলার মতো বড় কাজে সাফল্য অর্জন করা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব হবে না। সঙ্গে আমাদের চারপাশের পরিবেশ সুরক্ষার জন্যও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ থেকে আমাদের পরিবেশকে সুরক্ষার জন্যও উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবেশকে সুরক্ষার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে, স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমার সম্ভাবনা সফল হবে না।
সারা বিশ্বে উষ্ণায়নবিরোধী জনমত প্রবল হওয়া সত্তে¡ও শুধু আর্থিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে উন্নত দেশগুলো অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোর ওপর জলবায়ু সন্ত্রাস চালাচ্ছে, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। উন্নত দেশগুলোর অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার কারণে ইতোমধ্যে বায়ুমÐলের যে ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ তার কুফল পুরোটাই ভোগ করছে। বস্তুত এ ক্ষতির দায়ভার ধনী দেশগুলো কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আমরা আশা করি, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমুহ আগামী মাসের কোপ-২৬ এর সম্মেলনে ঐক্যমতের ভিত্তিতে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।