জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘তরঙ্গভঙ্গ’ প্রবাহমান ধারার বিপরীতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির একটি মঞ্চভাষা

144

মিখাইল মোহাম্মদ রফিক

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। বাংলা সাহিত্যের একজন কথাশিল্পী, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার। বাংলা সাহিত্যের একটি ক্রান্তিলগ্নে কথাসাহিত্যের আধুনিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক লেখনী দিয়ে। তাঁদেরই উত্তরসূরি এই কথাসাহিত্যিক নাট্যকার আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করলেও বিষয়, কাঠামো ও ভাষা-ভঙ্গিতে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছেন। ‘লালসালু’ উপন্যাসের চিত্ররূপ এখনো বাঙালি পাঠকের কাছে একটা স্থায়ী জায়গা দখল করে আছে। বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক আলোড়নে যখন নানাভাবে আলোড়িত, তখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলার গ্রাম ও সমাজ-জীবনের এক ধ্রæপদী জীবনধারাকে ‘লালসালু’ উপন্যাসে রূপদান করেন। যুগ যুগ ধরে শেকড় গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সংগে জীবনাকাক্সক্ষার দ্ব›দ্ব। গ্রামীণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ এর প্রতারণাজাল বিস্তারের মাধ্যমে, সে কিভাবে সমাজের কর্তা ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে, সেই কাহিনীই ফুটে উঠেছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লালসালুতে। তার এই সর্বগ্রাসী আত্মচেতনায় সে সঙ্গী করে গ্রামের মাতব্বরকেও।
গ্রামে যাতে সুষ্ঠু শিক্ষার প্রসার ঘটতে না পারে, তাই শিক্ষিত যুবক আক্কাসের স্কুল বানানোর প্রয়াস সে কৌশলে দূর করে, এভাবে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সে কুসংস্কার, শঠতা ও অন্ধবিশ্বাসের আশ্রয় নেয়, এভাবে কাহিনীর শেষ দিকে দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলার দৃপ্ত চেতনায় মজিদ তার আত্মনিয়ন্ত্রণ এর জায়গাটি খুজে পায়, এবং অনুশোচনায় জর্জরিত হলেও গড়ে তোলে তার মিথ্যার সা¤্রাজ্য। এই উপন্যাসে গ্রাম্য মাজার সংস্কৃতির আগ্রাসনকে গভীর চেতনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আরব দেশ থেকে আগত পির মুর্শিদ মারফৎ পাওয়া ধর্মে আমাদের দেশের অশিক্ষিত শ্রেণি দীক্ষা লাভ করলেও ধর্মের প্রকৃত রেশম রেওয়াজ থেকে তারা অনেক দূরে ছিল। নামাজ পড়া, কেতাব পড়া, দাড়ি রাখা, পিরের মাজারে সিন্নি পাঠানো, ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করা এ সবই তাদের কাছে ধর্ম। চেতনার অন্তলীন প্রবাহে এই উপন্যাসের ইঙ্গিতময় নির্দেশ আমাদের চোখ খুলে দেয়। ভাষার সূ² ইঙ্গিতময়তার গভীরতায়, আলঙ্কারিক কুশলতায় এই উপন্যাসে ওয়ালীউল্লাহ আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন নতুন বোধে, নতুন আলোকে, নতুন প্রগতিশীল ধারায়। জীবনের সহজাত প্রবৃত্তিই হয়তো সত্যের দিকে অগ্রসরমান, অন্তরের টানে, হৃদয়ীক মোহাচ্ছন্নতায় মানুষ অপর মানুষের দুঃখের সাথে অন্বিষ্ট হয়। মানবিক জীবনবোধ থেকে নিঃসৃত তাড়নাই সেখানে বড় প্রেরণা, অন্তঃসলিলা নদীর মতো মানবিক সূ² সদর্থক বোধই সেখানে বড় শক্তি; ধর্মীয় বিধিনিষেধ নয়, কিংবা উপরমহলের আরোপিত কোনো নৈয়ায়িক শৃঙ্খলাবোধের যুপকাষ্ঠে অধীর হয়েও অগ্রসর হওয়ার উদাহরণ নয়।
সামাজিক, ধর্মীয় জীবনের তাৎপর্যপময় রূপকল্প, ব্যক্তি জীবনের গভীরতম অন্তরদেশের রহস্যভেদ নির্মাণ, অপূর্ব মননশীল অন্তর্দৃষ্টি, তী² সূ² যুক্তিবোধ, আত্মকিত বোধ ও বিশ্বাসের ভাষা দ্বারা উপন্যাসের শরীর গঠনের জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ত্রয়ী উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে অনাগত দিনেও বিশিষ্ট স্থান দখল করে থাকবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। উপস্থাপনরীতিতে তাঁর উপন্যাস স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্মে উন্নীত হয়েছে। নিস্পৃহতা, আধুনিকতা, যুক্তিপরম্পরা, অত্যাধুনিক প্রায়োগিক কৌশল, নিজস্ব নৈয়ায়িক বোধ, পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য, প্রতিটি চরিত্রকে মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মোহভাবে অবলোকন, কাহিনির প্রতি পক্ষপাতহীন, নির্দ্ব›দ্ব বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিতে প্রতিটি ঘটনাকে উপস্থাপন সর্বোপরি মনোবিশ্লেষণের অপূর্ব তীক্ষèতা তাঁর উপন্যাসকে আলাদা মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেছে। তাঁর অন্য দুটি উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো বাংলা সাহিত্যে দুটি ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি।
তিনি এ দুটি উপন্যাসে ‘চেতনাপ্রবাহ রীতি’ ও ‘অস্তিত্ববাদ’-এর ধারণাকে অসাধারণ রূপক ও শিল্পকুশলতায় মূর্ত করে তুলেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা, দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ ও সুড়ঙ্গ রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভÐামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। ‘লালসালু’তে তিনি মানুষের চেয়ে টুপির সংখ্যা বেশি বলেছেন। আমাদের দিনে টুপি তো বটেই, নারীর সংখ্যার চেয়ে বোরকা-হিজাবের সংখ্যা বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে সেই লালসালুর চিত্র। জন্মশতবর্ষে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি তরঙ্গভঙ্গ নাটকের সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামে তির্যক নাট্যদল গভীরভাবে স্মরণ করেছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে। ‘তরঙ্গভঙ্গ’ কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র নাট্যকর্মের শ্রেষ্ঠ ফসল। এই নাটকের বাইরের ঘটনা আমাদের পরিচিত। আমেনা নামের অতি দরিদ্র এক মেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় হত্যা করেছে তার আদরের শিশু সন্তানকে এবং কঠিন রোগে
মরণাপন্ন ওষুধ বিহীন প্রিয়তম স্বামীকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে ধূতরা বিষ খাইয়ে হত্যা করে। বিচারালয়ের কাঠগড়ায় আমেনা অবিচলিত। কিন্তু জজ সাহেব বিষন্ন ও অন্তর্বাস্তবতায় ক্ষতবিক্ষত। আসলে তিনি এখানে আমাদের অসম সমাজ-ব্যবস্থার প্রকৃত স্বরূপটি ধরতে পেরেছেন। সমাজে যা কিছু সচরাচর ঘটে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একই ধারায়, একই তরঙ্গে আবর্তিত। তারপরও প্রশ্ন জাগে এবং অসংগতি দৃষ্ট হয়। তাই মানবিক ও নৈতিক বিষয়-বিবেচনায় এই প্রবহমান ধারার বিপরীতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির একটি মঞ্চভাষ্য ‘তরঙ্গভঙ্গ’। তির্যক নাট্যদল প্রযোজনা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত নাটক ‘তরঙ্গভঙ্গ’ গত ২১ অক্টোবর শুক্রবার এবং ২২ অক্টোবর শনিবার থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) মিলনায়তনে মঞ্চায়িত করে। তির্যক নাট্যদলের ৪৫তম প্রযোজনা আহমেদ ইকবাল হায়দার নির্দেশিত ‘তরঙ্গভঙ্গ’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয়- ২০১৬ সালের ৩ জুন। ইতোমধ্যে এই নাটকের ৪৮টি মঞ্চায়ন সম্পন্ন হয়েছে। এ বছর কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নবরূপে ‘তরঙ্গভঙ্গ’ মঞ্চায়িত হয়। ২২ অক্টোবর ‘তরঙ্গভঙ্গ’ নাটকের ৫০ তম মঞ্চায়ন পূর্ণ হয়। উল্লেখ্য, বিগত ৪৮ বছরে তির্যক নাট্যদল এ পর্যন্ত ৪৫ টি নাটকের ২,৭৩৩ টি প্রদর্শনী সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে ৮টি নাটকের শততম প্রদর্শনী এবং একটি নাটকের দ্বি-শত তম প্রদর্শনী সম্পন্ন করেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা, সৈয়দ আহমদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী যিনি ব্রিটিশ রাজ আমলে একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এ কারণে পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পিতার কর্মস্থলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত হয়। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনকে নানাভাবে দেখার সুযোগ ঘটে, যা তাঁর উপন্যাস ও নাটকের চরিত্র-নির্মাণ ও জীবন-অন্বেষণে প্রভূত সাহায্য করে।
১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রাজনীতিসম্পৃক্ত মানুষ ছিলেন না, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চাকরিহীন, বেকার। তা সত্তে¡ও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করেছেন, সঙ্গতিতে যতোটুকু কুলোয় তদানুযায়ী টাকা পাঠিয়েছেন কোলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। তাঁর সন্তানদের ধারণা, তাদের পিতার অকাল মৃত্যুর একটি কারণ দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা ও হতাশা। তিনি যে স্বাধীন মাতৃভূমি দেখে যেতে পারেন নি সে বেদনা তার ঘনিষ্ঠ মহলের সকলেই বোধ করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কালজয়ী কাজ তাঁর নাটকগুলো বিশেষত ‘তরঙ্গভঙ্গ’-এর মতো নাটকের সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা এখনো নিদারুণ ভাবে বাঙালি পাঠক সমাজে প্রশ্ন রাখে। সে সাথে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সম্মানের এবং গৌরবের।
লেখক : নাট্যকর্মী ও সাংবাদিক