জনহিতৈষী আলহাজ্ব এয়াকুব আলী চৌধুরী

133

এড. সালাহউদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু

চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার অন্তর্গত বটতলী গ্রামে ১৯০৯ ইংরেজি সালের এক শুভ লগ্নে জন্ম গ্রহণ করেন মরহুম আলহাজ্ব এয়াকুব আলী চৌধুরী। যিনি এয়াকুব মিয়া হিসেবে সমাধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর এ কৃতি পুরুষের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার পিতা মরহুম আছদ আলী চৌধুরী দোভাষী একজন স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বার্মার সাথে ব্যবসা করতেন। জনাব আছদ আলী চৌধুরী দোভাষী ২২ জুলাই ১৯০৭ ইংরেজী হতে আমরণ বটতলী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্বে ছিলেন এবং চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের তৎকালীন জুরী বোর্ডের জুরার (বিচারক) ছিলেন। বংশ পরম্পরায় আছদ আলী চৌধুরীর মৃত্যুতে তার জ্যৈষ্ঠপুত্র আবদুল আজিজ চৌধুরী ১৯২৪ ইংরেজী সনে বটতলী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে ও জুরী বোর্ডের সদস্য পদে আসীন হন। শিক্ষায় এলাকাকে আলোকিত করার লক্ষ্যে মরহুম আবদুল আজিজ চৌধুরী নিজ অর্থায়নে ও জমিতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯১৬ ইংরেজী সালে বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) এম.ই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ১৯২৭ ইংরেজীতে বটতলী পোস্ট অফিস স্থাপন করেন। তিনি ২১ জানুয়ারী ১৯৪৫ ইংরেজীতে পরলোক গমন করেন।
পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মরহুম আবদুল আজিজ চৌধুরীর অনুজ মেধাবী, বিচক্ষণ ও তীক্ষ্ন বুদ্ধি সম্পন্ন আলহাজ্ব এয়াকুব আলী চৌধুরী ১৯৪৫ ইংরেজীতে বটতলী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে ১৯৭০ ইংরেজী সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তীতে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৬ বৎসর কাল বটতলী ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ক্রীড়া সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং একজন ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ছিলেন। জনপ্রিয় এ নেতা ১৯৫৪ ইংরেজী সালে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আনোয়ার চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি একজন দক্ষ বিচারক ছিলেন। জনাব চৌধুরী অত্যন্ত ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের তৎকালীন জুরী বোর্ডের জুরার (বিচারক) এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পশ্চিমচাল সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং আনোয়ারা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অন্যতম দাতা সদস্য ছিলেন। উন্নয়নের মূর্ত প্রতিক এয়াকুব চৌধুরী বটতলী ইউনিয়ন পরিষদে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে প্রচুর সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মান করেন। তৎমধ্যে উল্লেখযোগ্য হাজারী হাট সেতু ও সড়ক, আইরমঙ্গল সেতু ও সড়ক, শ্রীমতি খাল সেতু ও সড়ক, মমতাজ পাড়া সেতু ও সড়ক, সলিমুল্লাহ সড়ক ও সেতু, বটতলী-বরৈয়া সড়ক, বটতলী- আনোয়ারা সড়ক প্রভৃতি। তৎকালীন বটতলী ইউনিয়ন পরিষদের পাকা ভবনটি তিনি নির্মান করেন। পরবর্তী আমলে উক্ত ভবনটি পুনঃ নির্মাণের জন্য ভেঙ্গে ফেললেও তা অদ্যাবধি নির্মাণ হয়নি। ধর্মপ্রাণ এয়াকুব চৌধুরী বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) জামে মসজিদ, রুস্তম হাট জামে মসজিদ, নুর পাড়া জামে মসজিদ, আইরমঙ্গল (বুড়িপুকুর) জামে মসজিদ নিজে সংস্কার করেন। ১৯৬০ ইংরেজী সালের প্রলয়ংকরী ঘুর্নিঝড়ে আনোয়ারা উপজেলায় অনেক লোকের প্রাণহানি ও ব্যাপক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। তখন অত্র এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেঃ খালেদ মোশারফকে তার বাসভবনে কন্ট্রোল রুম খোলার ব্যবস্থা করে দেন এবং তিনি খালেদ মোশারফকে সাথে নিয়ে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্য পরিচালনা করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সমগ্র আনোয়ারায় বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা হয়। ১৯৭৭ ইংরেজী সালের মার্চ মাসে বটতলী ইউপি ভবনে আনোয়ারা বিদ্যুতায়ন অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়। এলাকার নিরক্ষরতা দুরীকরাণার্থে তিনি এলাকায় একটি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। রুস্তম হাট উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনি, তার অগ্রজ আবদুল আজিজ চৌধুরী ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র ছালেহ আহমদ চৌধুরী নিজস্ব জমি দান করেন। হযরত শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) মাজার শরীফ অতীতে মাটির গৃহ ছিল পরবর্তীতে তিনি ও তার ভ্রাতা আবদুল আজিজ চৌধুরী মাজার শরীফের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে ব্যাপক উন্নয়ন করেন। মরহুমের পিতা মরহুম আছদ আলী চৌধুরী দোভাষী মাজার শরীফের প্রধান ফটকের পূর্ব পার্শ্বে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
অনগ্রসর এলাকাকে শিক্ষয় আলোকিত করার মহৎ উদ্দ্যেশে এয়াকুব আলী চৌধুরী তার অগ্রজ আবদুল আজিজ চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) এম,ই বিদ্যালয়কে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ও সকল প্রতিক‚লের মাঝে একক প্রচেষ্টায় ১৯৪৮ ইংরেজী সালে নিম্ন মাধ্যমিক ও ১৯৫৪ ইংরেজী সালে উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত করেন। এই আলোকবর্তিকা উক্ত বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির প্রথম সভাপতি পদে ছিলেন এবং তিনি উক্ত পদে দীর্ঘকাল দায়িত্বে থেকে তার একক প্রচেষ্টায় অত্র বিদ্যালয়কে সম্প্রসারন, প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অত্র বিদ্যালয়ে S.S.C পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেন। তদ্রুপ আনোয়ারা স্কুলের S.S.C পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনে অনন্য ভূমিকা রাখেন। জনাব চৌধুরী অত্র এলাকার সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষার অভাব অনুভব করায় তিনি ১৯৭৬ ইংরেজী সালে প্রতিষ্ঠা করেন শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) এয়াকুবিয়া দাখিল মাদরাসা। উক্ত মাদ্রাসার জন্য জমি দান করেন তার স্নেহভাজন একমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্র বিশিষ্ট দানবীর মরহুম আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী। জনাব এয়াকুব চৌধুরী বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে সহায়তা করে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি প্রারম্ভিক অধ্যক্ষ জিতেন্দ্র লাল দে ও কয়েকজন অধ্যাপককে নিয়ে কলেজের কার্যক্রম আরম্ভ করেন। জনাব চৌধুরী উক্ত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মরহুমের হাতে গড়া উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহ কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। মরহুম সমাজসেবা ও শিক্ষায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন সরকার বটতলী-বরৈয়া সড়কটি ‘এয়াকুব আলী চৌধুরী সড়ক’ নামকরণ করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অনন্য অবদান রাখেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। তৎকারণে রাজাকাররা তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু হযরত শাহ্ মোহছেন আউলিয়া মাজারের পার্শ্ববর্তী বাড়ি হওয়ায় রাজকাররা পিছু হটে।
শিক্ষা, ধর্মীয় ও জনকল্যাণ কার্যে তার অবদান অনস্বীকার্য। জনহিত কার্যের জন্য এয়াকুব আলী চৌধুরী ও তার ভ্রাতা আবদুল আজিজ চৌধুরীকে বৃটিশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণের মেডেল, আংটি, সনদ প্রদান করেন। তাদের দুই সহোদরের বিভিন্ন সরকার হতে প্রাপ্ত প্রশংসাপত্র, সনদ, পরিদর্শন রিপোর্ট বই ও অনন্য উপহার সামগ্রী এখনো অত্যন্ত যতœ সহকারে সংরক্ষিত রয়েছ্।ে অনেক জাতীয় নেতা, মন্ত্রী, এম,পি, বিচারক দেশের অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ মরহুমেরর বাসভবনে আগমন, অবস্থান লপান ও তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। জনাব এয়াকুব আলী চৌধুরী ২০০১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নয়, তিনি একটি আদর্শ ও প্রতিষ্ঠান। একটি উন্নত ও আলোকিত সমাজ গঠনই ছিল তার মূল লক্ষ্য। তিনি কোনদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। তার শাসনামলে বিচারপ্রার্থী জনগণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হননি। মরহুম আমৃত্য মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তার অবদান চির অম্লান এ পৃথিবীর লোকালয়ে।
লেখক: কলামিস্ট, রাজনীতিক