জনহিতকর কর্মে অর্থব্যয়ই হতে পারে মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠতম উপহার

78

বাংলা ও বাঙালির অকৃত্রিম সুহৃদ, পরম প্রিয় বন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচেছিলেন মাত্র (১৯২০-১৯৭৫) পঞ্চান্ন বছর। এই ৫৫ বছর থেকে তাঁর কারাগার জীবনের প্রায় ১২ বছর বাদ দিলে দাঁড়ায় মাত্র ৪৩ বছর। আর এই ৪৩ বছর থেকে তাঁর শৈশব কৈশোরের ১৮ বছর বাদ গেলে হয় ২৫ বছর। এই সীমিত সময়ে একজন মানুষ কীভাবে একটি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তা ভাবতেই অবাক লাগে। শুধু তাই নয়, তিনি একটি জাতিকে শুধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি সেই জাতিকে উপহার দিয়েছেন বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা নামের সোনার হরিণ। জন্ম দিয়েছেন পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বতন্ত্র ভূখÐের। তুলে দিয়েছেন বাংলার মানুষের হাতে লাল সবুজের একটি অনন্য সুন্দর পতাকা। উপহার দিয়েছেন হৃদয়ছোঁয়া গানের কলি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি—— কী শোভা, কী ছায়াগো,কী স্নেহ কী মায়া গো-কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে।’ এতে করে আমরা সহজেই বুঝতে পারি এই মানুষটির জন্ম না হলে আমরা কখনো পেতাম না পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় আর আলো জ্বলমল শহর,নগর,গন্জ। বিশ্ববাসী জানত না বাঙালি নামে এক লড়াকু জাতির কথা। যারা অসাধ্যকে সাধন করতে জানে এবং তারা তা করে দেখিয়েছে মাত্র নয় মাসে শুধু অদম্য ইচ্ছায় শক্তিশালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে। বাঙালির অসীম সাহস আর জানবাজি রাখা বীরত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে প্রায় তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। তাঁর হাতে বাঁশি ছিল না কিন্তু কণ্ঠে ছিল যাদু। তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য একদিকে ছিল চুম্বকের মতো অন্যদিকে তা ছিল বারুদের মতো। তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত মায়াবী শব্দমালার বলে তিনি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতাসহ সব পেশার মানুষকে এককাতারে একই মোহনায় এনে জড়ো করেছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম মানবতাবাদী লেখক আবুল ফজলের এক প্রবন্ধে তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই, ‘সারা বাংলাদেশে শেখ মুজিবের নাম এক যাদুমন্ত্র। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শিশু-বৃদ্ধ অন্তঃপুরিকা বধূ সকলের মনে এ নাম বয়ে আনে এক অপূর্ব শিহরণ। এ নাম যেন তাদের সামনে অন্ধকারে এক উজ্জ্বল প্রদীপশিখা। শেখ মুজিব বাঙালি মনে অনেক সূর্যের আলো। শেখ মুজিবের বিশেষ অবদান তিনি বাঙালিকে আত্মসচেতন করে তুলেছেন, বাঙালি জাতীয়তাকে দিয়েছেন ভাষা। বাঙালির অভাব- অভিযোগ, দাবি-দাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাংলার নগরে -বন্দরে, শহরে -গ্রামে, ধনীর অট্টালিকা থেকে গরিবের পর্ণকুটির পর্যন্ত সর্বত্র পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘জয়বাংলা’ সেøাগান বাংলা ও বাঙালির আত্মসন্ধান আর আত্ম-আবিষ্কারেরই যেন এক অমোঘঅস্ত্র।’ (খ্যাতিমানদের চোখে বঙ্গবন্ধু, মুনতাসির মামুন, বাশিএ ৭২০, পৃষ্ঠা-৩৬)
কিশোর বয়স থেকেই তিনি মানুষের কথা ভেবেছেন। এই মানুষ বাংলাদেশের মানুষ। তিনি এদেশের মানুষকে কতটা ভালোবাসতেন তা বোঝা যায় তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে করা একটি মন্তব্য থেকে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন হয়ে দেশে এসেছিলেন। লন্ডনে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, পাকিস্তান কারাগারে আপনি যখন দেখলেন আপনার কবর খোঁড়া হচ্ছে তখন আপনার কার কথা মনে হয়েছিল? তিনি বলেছিলেন, দেশবাসীর কথা। ( সেলিনা হোসেন, সচিত্র বাংলাদেশ, জানুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা-০৬)
এই সেই বন্ধু—বাংলার মানুষের বন্ধু, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও যিনি বলতে পারেন দেশবাসীর কথা। বলতে পারেন আমাকে হত্যা করবে জানি, তবে তোমাদের কাছে একটাই প্রার্থনা ‘তোমরা আমার মৃতদেহটি আমার সোনার বাংলায় পাঠিয়ে দিও’।
দেশি -বিদেশি চক্রান্তের সামনে বঙ্গবন্ধু বরাবরই নির্ভীক ছিলেন। নিজের জীবনের জন্য কখনো ভীত ছিলেন না। বাঙালি জাতিকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো মানসিক দীনতাও তাঁর ছিল না। আর ছিল না বলেই তাঁর আশে পাশে যে সব বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, মীরজাফররা আস্তানা গড়ে তুলতে পেরেছিল তা তিনি আঁচও করতে পারেননি। ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ — কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর বাণীকে তিনি ধ্রুব সত্য মেনেছিলেন। সেজন্য নিরাপত্তার স্বার্থে নিজ বাসভবন ছেড়ে সরকারি বাসভবনে প্রহরীবেষ্টিত হয়ে থাকার কথা ভাবেননি। এতে করে গণমানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। কারণ তিনি তো ছিলেন গণমানুষের নেতা। মানুষের ভালোবাসার মূল্য দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুরোটা জীবন ছিল এ দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত, উৎসর্গিত। পরোপকার, অসম সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, ন্যায়ের পক্ষে অবিচল, আজন্ম আপোসহীন এ সব বিরল মানবীয় গুণাবলীর সবটাই তাঁর রক্তে একাকার হয়েছিল।ফলে মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও তিনি বাঘের মতো গর্জন করে বলতে পেরেছিলেন,’তোরা কি চাস ?’ কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?
আর মাত্র ৮দিন পরেই মুজিববর্ষের শুরু। এরকম একটি দিন এক জীবনে দুইবার পাওয়া যাবে না। তাই নিঃসন্দেহে এদিনটি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। এদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালন করবে এদেশের প্রতিটি মানুষ নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। জন্মদিনকে ঘিরে মানুষমাত্রই আন্দোলিত হয়, পুলকিত হয় এটাই স্বাভাবিক। আমরা আনন্দ করব ঠিকই কিন্তু সে আনন্দ যাতে মাত্রা ছাড়িয়ে না যায় সেদিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা, তাঁর স্বপ্নের কথা। তাঁর শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সাধনার কথা। যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করে তিনি দিনের পর দিন বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাই মুজিববর্ষের যেকোনো অনুষ্ঠানে আমাদের এসব বিষয় মনে রেখে কর্মসূচি সাজাতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে মুজিববর্ষকে ঘিরে এমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত হবে না যা বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা, আদর্শের পরিপন্থী হয়। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। সেই সংগ্রামের সুফল আমরা পেয়েছি ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী মরণপণ লড়াই করে। কিন্তু পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাÐ বাংলার মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি থেকে বঞ্চিত করেছে। পিছিয়ে দিয়েছে আমাদের অগ্রযাত্রাকে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা যে পদক্ষেপে একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারতাম, তা আমরা পারিনি। বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে এখন কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে দেশ। দেশ কারও একার নয়, দেশকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব সকলের। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে আমরা যদি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাহলে বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা বাস্তবে রূপ দিতে খুব একটা সময় লাগবে না।
এজন্যে সবার আগে প্রয়োজন অপচয়রোধ। যেখানে সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে হবে। লোক দেখানো অনুষ্ঠানের আয়োজন না করে সে অনুষ্ঠানের প্রাপ্ত, সংগৃহীত কিংবা বরাদ্দকৃত টাকা জনহিতকর কাজে ব্যয় করার পরিকল্পনা নিতে হবে। গৃহহীন মানুষদের গৃহনির্মাণ, কন্যাদায়গ্রস্হ পিতামাতার সাহায্যে এগিয়ে এসে তাঁদের দায়ভার লাঘব করা যেতে পারে। মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিটি উপজেলা থেকে একটি গরিব ঘরের মেয়ের বিয়ের খরচ বহন, প্রত্যেক ইউনিয়নে যেসব মানুষ দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন তাঁদের এককালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং প্রত্যেক গ্রামে নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করা যেতে পারে। গ্রামে গ্রামে, ইউনিয়নে ইউনিয়নে, উপজেলায় একাধিক অনুষ্ঠান না করে উপর্যুক্ত কাজগুলো সম্পাদনই হতে পারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং জন্মশতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম উপহার।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক