জনসচেতনতা ও সতর্কতার বিকল্প নেই

7

দেশে শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিদুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এসব দুর্ঘটনা কখনো কখনো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঘটে হতাহতের ঘটনাসহ ব্যাপক সম্পদের ক্ষতি। মূলত অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে প্রতিবছর অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয় মানুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগুনে গরমের স্পর্শ নিতে খড়কুটা জ্বালিয়ে উষ্ণতা গ্রহণ, রাতব্যাপী চুলা জ্বালিয়ে রাখা, শর্টসার্কিট, গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ, রান্নাঘরের ত্রæটিপূর্ণ চুলা, বিড়ি-সিগারেটের ফেলে দেওয়া জ্বলন্ত অংশ এবং মশার কয়েল থেকে ঘটে অগ্নিদুর্ঘটনা। পরিধেয় বস্ত্রে সরাসরি আগুন লেগেও অনেকে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ মানুষ নানাভাবে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হন। শীতে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি দেশে শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিদুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এসব দুর্ঘটনা কখনো কখনো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঘটে হতাহতের ঘটনাও। গত একবছরে চট্টগ্রামেও ব্যাপক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসময় শতাধিক মানুষের ৭কোটি ৪১ লাখ টাকার সম্পদহানির ঘটনাও ঘটেছে। একসময় নগরীতে আগুন লাগার ঘটনা বেশি হলেও এখন বিভিন্ন উপজেলায় অগ্নিকান্ডে ঘটনা ঘটছে। গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি শুষ্ক মৌসুমে নগরী ও জেলায় একের পর এক সংঘটিত অগ্নি-দুর্ঘটনায় বসত ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা পুড়ে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটসহ বিভিন্ন উৎস থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটছে। অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিহ্রাসে কেউ গরজবোধ না করায় অগ্নি-দুর্ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না। তাছাড়া পানির উৎস না থাকাসহ নানা কারণে আগুন নির্বাপণে গিয়ে ফায়ারকর্মীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে আনোয়ারা, লোহাগাড়ায় সম্প্রতি সংঘটিত দুটি অগ্নি দুর্ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়। তাতে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ও চুলার আগুনের ভয়াবহতা প্রকাশ পায়। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আগুনের ঝুঁকি’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ২০১৫ সাল থেকে পরবর্তী সাত বছরে তিন হাজার একশ’ ১৪ টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার ৬৬ শতাংশেরই উৎস ছিল বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। বাকি ১১ শতাংশ রান্নাঘরের আগুন, ১৩ শতাংশ বিপজ্জনক উপাদান, নয় শতাংশ সিগারেটের আগুন আর এক শতাংশ অন্যান্য কারণে সংঘটিত হয়েছে। অগ্নিকান্ডের ৪৭ শতাংশ ঘটে আবাসিক এলাকায়। বাণিজ্যিক এলাকায় ঘটে ২৭ শতাংশ। এ সময়ে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আহত হন একশ’ ১৫ জন এবং মারা যান ২৯ জন।
ফায়ার সার্ভিস ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বা ওভারলোডিং, ত্রুটিপূর্ণ সরবরাহ লাইন, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার, বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের লাইন ও যন্ত্রপাতি নিয়মিত চেকআপ ও প্রতিস্থাপন না করার কারণে চট্টগ্রামে বৈদ্যুতিক ত্রূটি থেকে অগ্নি-দুর্ঘটনা বাড়ছে। সতর্কতা অবলম্বনে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে আরও শক্তিশালী করা এবং তাদের ফায়ার ইক্যুইপমেন্টের যে অভাব আছে, তা দ্রুত পরিপূর্ণ করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে এক হাজার সাতশ’ ৮৩ টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকান্ডের আটশ’ ৮৭টি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া তিনশ ৯০টি সিগারেট ও একশ’ ৪৭টি চুলার আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে। একইসময়ে চট্টগ্রাম জেলায় ছয়শ’ ৭০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অগ্নিকান্ড ঘটে তিনশ’ ৩২টি। এছাড়া বিভাগের আওতাধীন কুমিল্লায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ছয়শ’ ৩৫টি, নোয়াখালীতে দুইশ’ ৯৮টি, রাঙ্গামাটিতে একশ’ সাতটি, বান্দরবানে ৪০টি ও কক্সবাজারে একশ’ ৭৯টি।
মূলত অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে প্রতিবছর অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয় মানুষ, সম্পদেরও ক্ষতি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শর্টসার্কিট, গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ, রান্নাঘরের ত্রুটিপূর্ণ চুলা, বিড়ি-সিগারেটের ফেলে দেওয়া জ্বলন্ত অংশ এবং মশার কয়েল থেকে ঘটে অগ্নিদুর্ঘটনা। পরিধেয় বস্ত্রে সরাসরি আগুন লেগেও অনেকে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ মানুষ নানাভাবে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হন।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি ও বহির্বিভাগে যারা চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই শিশু ও নারী। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। শুধু শুষ্ক মৌসুমেই নয়, সব সময়েই আগুন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বাসাবাড়িতে রান্না করার পর গ্যাসের চুলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখতে হবে। নিয়মিত গ্যাস সংযোগ ও লাইন পরীক্ষা করতে হবে। যত্রতত্র ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আগুন পোহানোর সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে গরম পানি, গ্যাসের চুলা ব্যবহার ও আগুন পোহাতে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়ে সরকার, গণমাধ্যম, চিকিৎসক এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো আরও বেশি গুরুত্ব দেবে, এটাই প্রত্যাশা।