‘জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে’

129

‘মা’। খুবই ছোট একটা শব্দ, কিন্তু কি বিশাল তার পরিধি! পৃথিবীজুড়ে মা’র পরম মমতাজড়ানো অনুগ্রহ ছাড়া শুধু মানুষ কেন, কোনও প্রাণীরই তো প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়। এক বর্ণের এই শব্দটিই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দও বৈকি! কবির ভাষায়, ত্রিভূবনে এর চেয়ে মধুর ডাক দ্বিতীয়টি নেই। সবচেয়ে গভীরতম সম্পর্ক এবং নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ও সেই মা।
মধুরতম এই শব্দটি উচ্চারিত হলেই যেন মনের গভীরে যুগপৎভাবে দোলা দেয় স্নেহ মমতা আর গভীর ভালোবাসার কথা। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে বেঁচে থাকা অবধি মায়ের কোল সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। জীবনে চলার পথে বিপদে-আপদে কিংবা সংকটে নিজের অলক্ষ্যেই মানুষের মনে সবার আগে যার কথা মনে পড়ে তিনি পরম মমতাময়ী মা। আর সবমিলিয়ে মায়ের চেয়ে পৃথিবীতে বড় কিছুই নেই। জন্মের পর শিশুর মুখে প্রথম যে বুলি ফুটে সেটিও ‘মা’। শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে যেন হৃদয়ের সমস্ত আবেগ আর অনুভূতি একাকার হয়ে দেহমনে প্রশান্তির শিহরণ জাগায়। রাষ্ট্র-ধর্ম-বর্ণ-জাতি ছাপিয়ে মা-ই হচ্ছে শিশুর সার্বজনীন ভাষা।
আজ ১২ মে বিশ্ব মা দিবস। মায়ের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর বিশেষ দিন। যদিও মায়ের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ বিশেষ কোনও দিনক্ষণ বা মুহূর্তের দেয়ালে বন্দী করে রাখার মত ব্যাপার নয়। মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রতিদিনের। শ্বাশ্বত ও চিরন্তন। তবুও ১৯০৮ সালে আমেরিকান শান্তিকর্মী আনা জার্ভিস আনুষ্ঠানিকভাবে বছরের একটি বিশেষ দিনে মা দিবস পালন করা সেই যে শুরু করেছেন, কালের পরিক্রমায় তা বিশ্বজুড়েই ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। কিন্তু মাতৃত্বের উদযাপন আদতে নতুন কোনও ধারণা নয়। সন্তানের জন্য মায়ের যে সীমাহীন অবদান ও ত্যাগ স্বীকার, তার প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন যুগে যুগে নানা সভ্যতাতেই ছিল। যেমন গ্রিক সভ্যতায় ‘সিবেল’ উৎসব, রোমানদের ‘হিলারিয়া’ কিংবা খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী ‘মাদারিং সানডে’র মাধ্যমে মায়ের জন্য বিশেষ একটি দিনের উদযাপন হাজার বছর ধরেই মানবসভ্যতায় প্রচলিত। আজকের মা দিবস অবশ্য সরাসরি সে ধরনের কোনও দিবস থেকে না আসলেও মাতৃত্বের উদযাপন আজও সার্বজনীন।
সন্তানের প্রতি মায়ের এই দুর্নিবার মমতা ও আকর্ষণকে বিজ্ঞানও ব্যাখ্যা করেছে সন্দেহাতীতভাবে। ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান বলে, মায়ের বুকের দুধে এক প্রকার রাসায়নিক যৌগিক পদার্থ আছে – যা সন্তানের দেহে প্রবেশ করলে মা ও সন্তানের মধ্যে চুম্বক প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি হয়। মায়ের দেহে নিউট্রোপেট্রিক রাসায়নিক পদার্থ থাকায় মায়ের মনে সন্তানের জন্য মমতা জন্ম নেয়। তবে, মায়ের ভালোবাসার ক্ষমতা বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
আমাদের ‘চারণশিল্পী’ নকুল কুমার বিশ্বাস বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে ‘ম’ বর্ণকেই সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, ম বর্ণ দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘মা’ থেকে শুরু করে মক্কা, মদিনা, মন্দির, মসজিদের মত সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান ও মূল্যবান ব্যক্তির নামাঙ্কিত হয়েছে। তাই আজ আপনিও মায়ের জন্য হৃদয়ের সমস্ত আবেগ উজাড় করে দিয়ে গীতিকবি অতুল কৃষ্ণ মিত্রের লেখা উপমহাদেশের খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী পান্না লাল ভট্টাচার্যের গাওয়া বিখ্যাত সেই গানটির কয়েক চরণ মাকে উদ্দেশ্য করে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠতেই পারেন- ‘মা, আমার সাধ না মিটিল/ আশা না পুরিল/ সকলি ফুরায়ে যায় মা/ জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে/ কোলে তুলে নিতে আয় মা…’।