জনপ্রশাসন হোক জনবান্ধব ও জনকল্যাণমুখী

63

মো. আবদুর রহিম

অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের সিভিল সার্ভিসের সাংগঠনিক কাঠামো, কাজের ধরণ এবং ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বণিকের মানদন্ড যখন রাজদন্ডের রূপ নিল তখনও তা জনকল্যাণে নিবেদিত হতে পারেনি-জনবান্ধব ছিল না। সিভিল সার্ভিস ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটা প্রভু ভৃত্যের সম্পর্কের মতো ছিল। সে কারণে সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত চিন্তা ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের কার্যসম্পাদন পদ্ধতি, কাঠামো আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি-কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এ বিষয়গুলো অনুধাবন করে স্বাধীনতার পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানব সম্পদ উন্নয়ন ও এর যথাযথ ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি সিভিল সার্ভিসকে জনবান্ধব, জনসেবামূলক ও জনকল্যাণধর্মী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সিভিল সার্ভিস ও সরকারী কর্মচারীদের প্রসঙ্গে এক ভাষণে বলেন, “সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনাদের জনগনের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’র এ কথার মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে জনকল্যাণে সরকারী কর্মচারীদের আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালনে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় প্রতিফলিত হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং এর যথাযথ ব্যবহার জনপ্রশাসনের একটা অন্যতম কাজ। সরকারি সেবার তাৎপর্য ও মূল্যায়ন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরকারি সেবার অবদানকে তুলে ধরা, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ভালো কাজের স্বীকৃতি প্রদান এবং তরুণদের প্রজাতন্ত্রের কর্মকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২৩ জুন আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস দিবস উদ্্যাপন করা হয়।
বর্তমান জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে জনসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ‘সরকারি কর্মচারি আইন ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। যা সিভিল সার্ভিসে মানব সম্পদ এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করবে। সরকারি সেবাসমূহকে জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে প্রতিটি ইউনিয়নের ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে যা সরকারি সেবা গ্রহণকে করেছে অনেক সহজলভ্য। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৃণমূল পর্য্যায়ে সরকারি সেবাসমূহ সহজলভ্য করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলিকে সহায়তা প্রদান এবং নিবিড়ি মনিটরিং করা হচ্ছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভূমিকা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সেবা প্রদানের জন্য ভূমি সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ডিজিটালাইজড খতিয়ান প্রস্তুত, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমির মালিকানা হালনাগাদকরণ, অনলাইন ভূমি ও রেজিষ্ট্রি সেবা এবং দলিল ক্যালকুলেটর অ্যাপ, অন লাইনে অর্পিত সম্পত্তি ইজারা প্রদান হাল নাগাদ, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধকল্পে অ্যাপ, ইউনিয়ন পরিষদে ডিজিটাল সার্টিফিকেট প্রদান ও জন্মনিবন্ধন ইত্যাদি সেবা প্রদানের মাধ্যমে সরকারি সেবাসমূহকে জনগণের নিকট সহজলভ্য করা হয়েছে। বিশ^ায়নের এই যুগে অগ্রসরমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে জনসাধারণের চাহিদাকে সামনে নিয়ে সরকারি সেবা প্রদানের ধরণে বৈচিত্র্য এসেছে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে এবং সেবা সহজীকরণে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে পথচলা তা কেবল এ দেশের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তা নয়, আন্তর্জাতিক পরিমÐলেও তা প্রশংসিত হচ্ছে। সেবা সহজীকরণ ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে ডিজিটাল সেবা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ৫ বার ডঝওঝ অধিৎফ অর্জন করেছে যা এক অনন্য কৃতিত্ব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় তার অনবদ্য নেতৃত্ব ও অবদানের জন্য ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞবষবপড়সসঁহরপধঃরড়হ টহরড়হ (ওঞট) কর্তৃক ‘ওঈঞ ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ অধিৎফ’ ভূষিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয় ‘ওঈঞ ভড়ৎ উবাবষড়ঢ়বসবহঃ অধিৎফ ২০১৬’ এ ভূষিত হয়েছে। এ সকল স্বীকৃতির সর্বশেষ সংযোজন বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় ‘ই-মিউটেশন’ পদ্ধতির ২০২০ সালের টহঢ়ঁনষরপ ঝবৎারপব অধিৎফ (জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস পুরস্কার) ২০২০ অর্জন। সরকারি সেবা সহজীকরণে বাংলাদেশের এ উদ্যোগ এবং জনসেবায় উৎসর্গ ও সৃজনশীলতাকে বিশ^ সংস্থার এ স্বীকৃতির ফলে আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিতকরণে মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দক্ষ মানবসম্পদ যে কোনো রাষ্ট্রের জন্যই একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন বিশ^ায়নের প্রভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ টিকে থাকার লড়াই শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পাবলিক সেক্টরকে প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। সে কারণে দক্ষ ও যুগোপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং সম্পদকে কৌশলগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। পাবলিক সেক্টরে সুষ্ঠু মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ প্রয়োগ একটি রাষ্ট্রের সরকারি কর্মচারীগণকে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে জাতীয় এবং বিশ^ অর্থনীতিতে দক্ষতার সাথে অবদান রাখার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
একটা গণতান্ত্রিক দেশে সিভিল সার্ভিস আধুনিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা গড়তে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক সরকার ধারণাটি রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেকগুলি উপাদানের সমষ্টি। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সরকার ও সুশাসনকে শক্তিশালীকরণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করে। মানব সম্পদের উন্নয়ন ও সুষ্ঠ সুশাসনের লক্ষ্য অর্জনে মৌলিক শর্ত। একটি দক্ষ, যোগ্য ও কার্যকর সিভিল সার্ভিসের উপস্থিতিতে সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। জনগণের কল্যাণে সুশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন ইতিবাচিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কৌশলগত সক্ষমতা। আর সেজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী সিভিল সার্ভিস কাঠামো, যা হবে জনকল্যাণমুখী ও সেবাধর্মী।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। দারিদ্র বিমোচন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, অবকাঠামো বিনির্মাণ, খাদ্য নিরাপত্তা ও সমাজিক সুরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। অধুনা বৈশি^ক মহামারি করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুরদৃষ্টিপূর্ণ প্রজ্ঞাময় দিকনির্দেশনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীগণ সর্বোচ্চ সেবার মাধ্যমে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যা জনবান্ধব প্রশাসনের জনসেবার এক বিরল নজির। সরকার ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ (এসডিজি) লক্ষ্য অর্জনের জন্য মেধাবী, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ও জনবলের কর্মস্পৃহা ও উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনসেবার পদ্ধতির পরিবর্তনের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর কাক্সিক্ষত দক্ষ ও জনবান্ধব জনপ্রশাসনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং প্রিয় বাংলাদেশকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আরো জনবান্ধব ও জনকল্যাণের মানসিকতা নিয়ে সর্বোচ্চ মেধা, পরিশ্রম, একাগ্রতা নৈতিক মূল্যবোধ ও জনসেবার মানসিকতা নিয়ে কর্মে নিযুক্ত হতে হবে। তাহলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। সকলের জীবন হউক নিরাপদ ও সফল।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক- বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ