জনগণের করের অর্থে ভিআইপি লালন প্রভুত্ববাদী মানসিকতা

32

এক যুগ্ম সচিবের (জয়েন্ট সেক্রেটারি) অপেক্ষায় মাদারীপুরের কাঠালবাড়ি ঘাট থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে ফেরি ছাড়ায় স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা রিটের শুনানিতে ভিআইপি প্রটোকল বিষয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ভিআইপি নন, বাকিরা সবাই প্রজাতন্ত্রের সাধারণ কর্মচারী মাত্র। চাকুরি ক্ষেত্রে তাদের কোনও আলাদা মর্যাদা দেয়া যায় না। বিচারপতি এফ আরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রতি এ মন্তব্য করেছেন। ৩০ জুলাই তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট যুগ্মসচিব ও ফেরি ম্যানেজারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট দায়ের করা হয়। নড়াইল কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলে তাকে খুলনার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য আইসিইউ সংবলিত একটি অ্যাম্বুলেন্সে ২৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশে রওনা দেন পরিবারের সদস্যরা। ওই রাত ৮টায় কাঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌ পথের মাদারীপুরের ফেরিঘাটে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্সটি। তখন কুমিল্লা নামে ফেরিটি ঘাটে যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্মসচিব পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাবেন বলে ওই ফেরিকে অপেক্ষা করতে ঘাট কর্তৃপক্ষকে বার্তা পাঠানো হয়। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফেরিতে ওঠে অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু এর মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় তিতাস।


আমরা সবাই জানি, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সংবিধান অনুযায়ী, সব সময় জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কাজ। এ কর্তব্যের অংশ হিসেবেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অর্পিত দায়িত্ব সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে পালন করতে হয়। দায়িত্ব পালনে অতিকথন বা বেফাস, বা বেআইনি বক্তব্য বা পদক্ষেপ নেবার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭ এর (১) ধারায় বলা হয়েছে। ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক দেশের জনগণ; জনগণের পক্ষে, সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’
১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্ব ও অধিকার খুব জোড়ালো ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর পরও দেশে জনগণেরর সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে মনে হয় না, উল্টা বরং পাবলিক সার্ভেন্টদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের প্রভুত্ববাদী মনোভাব সংবিধানের এই মূল চেতনাকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের দেয়া করের টাকায় রাষ্ট্র চলে। যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন ভাতা, যানবাহন, আবাসনসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছে। তা জনগণের করের টাকায়। জনগণের করের টাকায় প্রজাতন্ত্রের সব খরচ নির্বাহ হয়ে থাকে। এমন কি বিদেশ থেকে যে ঋণ বা অর্থ সাহায্য আসে তাও কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি বিশেষকে দেয়া হয় নাÑ তাও দেয়া দেশের জনগণের নামে। তাই সংবিধান, আইন, নৈতিকতা কোনো দিক থেকেই জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তারা লাট বাহাদুর নন। বেতন নেবেন জনগণের টাকায়, শপথ নেবেন সংবিধান সমুন্নত রাখার, অঙ্গীকার করবেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার, কিন্তু জনগণকে অবহেলা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন এটি হতে পারে না। এটি স্ববিরোধী।
১৯৭২, ১৯৭৩ সাল বা নব্বইয়ের দশকেও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্বের বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সংবাদ মাধ্যমে বা জনসমক্ষে কোনো বক্তব্য দেয়ার নজির খুব একটা ছিল না। আমাদের জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ছিলেন এ ধরনের প্রথার ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি বারবার সরকারি কর্মচারীদের জনগণের খেদমত করার তাগিদ দিয়েছেন। ওই সময়ে দায়িত্বের প্রয়োজনে সংবাদ মাধ্যম বা জনসমক্ষে বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রেও তাদের পরিমিতবোধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সংবাদমাধ্যমে বা জনসমক্ষে দায়িত্বের প্রয়োজন ছাড়াও বক্তব্য দেয়া শুরু। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে অতিকথন ও বেফাস বক্তব্য। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে আচরণ বিধির প্রয়োগ তেমন একটা না থাকায় বর্তমানে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা এখন প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে জনসমক্ষে ও সংবাদমাধ্যমে অহরহ বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন; যা তাদের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করছে। জনমনে আতংক, বিভ্রান্তি বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
সংবিধানের ৩৯(২) বিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালিনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইন দিয়ে আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সব নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য বাধা নিষেধের অতিরিক্ত চাকরি সংক্রান্ত বিধিবিধান দিয়ে আরোপিত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী তার বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তাদের জন্য প্রযোজ্য সরকারি কার্যবিধি ও আচরণবিধির বিধান উপেক্ষা করে বাকস্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন না। আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী রাজনৈতিক কর্মকাÐে সম্পৃক্ত হতে পারেন না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া রাজনৈতিক কর্মকাÐের অংশ হিসেবে বিবেচিত। কেননা যে নির্বাচিত সংকারের রাজনৈতিক মুখপাত্রের কাজ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর দায়িত্বের অংশ। যার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর কোনো কথা রাজনৈতিক বক্তব্যের পর্যায়ভুক্ত হলে, তা আচরণবিধি পরিপন্থী। আচরণবিধির পরিপন্থী যেকোনো কাজ অসদাচরণ হিসেবে গণ্য। অসদাচরণের জন্য চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো গুরুদÐ প্রয়োগযোগ্য। অথচ আমাদের পদ্ধতিটি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে পাবলিক সার্ভেন্টের পরিবর্তে ‘লর্ড অব পাবলিক’ বানিয়েছে। যোগদানের আগ মুহ‚র্তে তিনি দেশ, সংবিধান ও জনস্বার্থের প্রতি চির আনুগত্যের অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষর করেন। কিন্তু সিস্টেম তাকে জনসেবকের পরিবর্তে জনশাসকে পরিণত করে। এমানসিকতা শুধু পাবলিক সার্ভিসে নয়, এটি সর্বব্যাপী, আমরা যে কোনো সবলব্যক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর প্রভুত্ব করা বা অযথা হয়রানি, অবজ্ঞা, অবহেলা করার মানসিক রোগে আক্রান্ত। নিজের থেকে উচুস্তরে আপ্রাণ তৈলমর্দন এবং নিম্নে অবস্থানকারীদের প্রতি উল্টো আচরণ আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে।
প্রত্যেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সাংবিধানিক পদমর্যাদায় নিযুক্ত সবাইকে শপথ গ্রহণ করতে হয়। প্রজাতন্ত্রের সুবিধাজনক পদে থেকে জনগণের ওপর সুপ্রিমেসি একটি প্রভুত্ববাদী মানসিকতা এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারী সরকারের কার্যবিধিমালা ও আচরণবিধি মেনে চলবেন। আর সরকারও এই আচরণবিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে সচেষ্টা হবেনÑ এটিই জনগণের প্রত্যাশা। সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব।
আগেই বলা হয়েছে আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্র পরিচালনায় কাজে নিয়োজিত জনপ্রতিনিধি ও জনসেবকদের প্রধান কাজ যেখানে জনগণের সেবা নিশ্চিতকরণ সেখানে তারা জনসেবার পরিবর্তে যদি নিজের সেবায় নিমগ্ন থাকেন, তাতে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম তা ব্যাহত হয়। আর তাই জনগণের করের অর্থে এভাবে ভিআইপি লালন করা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত ও প্রত্যাশিত নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট