জঙ্গিবাদ নির্মূলে অবিচল জিনাত সোহানা চৌধুরী

19

নিজস্ব প্রতিবেদক

মফস্বলে কিংবা শহরে বসবাসরত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের অনেক শিশুরই পড়াশোনার শুরুটা হয় ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে। পরবর্তীতে এই শিশুদের এক অংশ চলে যায় স্কুলে, আরেক অংশের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু হয় মাদ্রাসাতে। নিজেদের নয়, অভিভাবকের আকাক্সক্ষাতে বদলে যায় তাদের চাওয়া পাওয়া, সুযোগ সুবিধাগুলো। ফলে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জাতীয় সংগীত চর্চার কোনো প্রচলন যেমন নেই, তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেবার প্রযোজনও অনুভব করে না অভিভাবক, শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের কেউই।
বন্দি জীবনে আটকে যায় তাদের উড়ন্ত শৈশব। যেই সময়টা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, আনন্দে কাটানোর সেই সময়টায় কঠিন এক জীবন আবদ্ধ করে ফেলে এসব মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের। অন্য কোনো বিনোদন তো দূরে থাক, তার দৈনন্দিন রুটিন থেকে জাতীয় সংগীত বলে শব্দটিই নাই হয়ে যায়। ‘চার দেয়ালের বাইরে বের হওয়াও নিষিদ্ধ। যেখানে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এমনকি দৌড়াদৌড়ি, উচ্চশব্দে হাসাহাসিতেও বারণ, সেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়া তো কল্পনার বাইরে। ফলে জাতীয় সংগীত, জয় বাংলা স্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের গল্প ইতিহাস মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে অপাংক্তেয় বিষয়।
জিনাত সোহানা পেশায় একজন আইনজীবী। আইন পেশার পাশাপাশি সুচিন্তা ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের বিভাগীয় সমন্বয়ক। নির্যাতিত নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে তার কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। কাজ করেছেন চট্টগ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেম জাগানোর মহান ব্রত নিয়ে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে জাতীয় সংগীতের প্রচলনের এমনই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জকে সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন জিনাত সোহানা চৌধুরী।
তাই জঙ্গিবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সীমানায় বাঙালি জাতিসত্ত¡ার গৌরব ছড়াবে এমন স্বপ্ন দেখেছেন জিনাত সোহানা। দেশের নানা প্রান্তে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সব ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্য বিলোপের পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। এসব শিক্ষার্থীদের কাছে দেশপ্রেম তৈরির এ আন্দোলনের শুরুটা জিনাত সোহানা করেছেন তার ব্যক্তিজীবন থেকে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক প্রতিরোধে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালিয়েছেন প্রচারণা।
চট্টগ্রামের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান -যেখানে কখনো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হয়নি, জাতীয় সঙ্গীত যেখানে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে শিক্ষা নেওয়া যারা মেনে নিতে পারেন না, সেই সব কওমি মাদ্রাসায় জয় বাংলা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরি করে বেড়িয়েছেন দুঃসাহসী এই নারী। শুধু কওমি মাদরাসা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মাদ্রাসায়ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের গল্পগাঁথা নিয়ে নিয়মিত হাজির হতেন তিনি।
পেশায় আইনজীবী হলেও ‘জয় বাংলা স্লোগান’ আর মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরি করে বেড়ানোই হয়ে উঠে তার নেশা। নারীত্বের বাধাকে জয় করে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের শোনান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গল্প। তার দীপ্ত পদচারণায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান আর জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়েছে শত শত মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশের আয়োজন করে। এসব সমাবেশে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গল্প আলোচনা করেন, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে কথা বলেন।
জিনাত সোহানা চৌধুরীর উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিভাগে শত মাদ্রাসায় জঙ্গিবাদ বিরোধী ¯েøাগান ধ্বনিত হয়।
জানতে চাইলে জিনাত সোহানা বলেন, আমি সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের সংগঠকদের সাথে নিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারণা করছি চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে। এর পাশাপাশি ইসলামে দেশপ্রেমের স্থান, গুরুত্ব কোথায়, পড়–য়াদের শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য মাদ্রাসা বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে চেষ্টা করছি একটি সিলেবাসও তৈরির করতে। যাতে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হবে, তারা যে ধর্ম অনুসরণ করে অর্থাৎ ইসলাম, তাতে দেশপ্রেমকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, দেশকে যারা ভালবাসে, তাদের কতটা মহান করে দেখানো হয়, দেশের প্রতি আনুগত্যকে কতটা বিরাট মূল্য দেওয়া হয়।
গত ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনার আবির্ভাব হলো বাংলাদেশেও। তখনও অদম্য সাহসী জিনাত সোহানা নিজেকে উপস্থাপন করলেন মানবতাবাদী নারী হিসেবে। দেশের পরিস্থিতি তখন এমন যে, করোনা রোগী তো দ‚রের কথা স্বাভাবিক জ্বর-সর্দির কথা শুনলেই ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছিলো সাধারণ মানুষ। করোনা সন্দেহের জেরে কোথাও কোথাও উপসর্গ থাকা রোগীকে নিষ্ঠুর প্রতিবেশিরা একঘরে করে রাখার মতো অমানবিক আচরণ করেছেন। করোনার এই বিষ বাষ্পের ভয়ে নিজের আপনজনের শেষ বিদায় দিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেকের।
এমনই এক কঠিন মুহূর্তে নগরীর হালিশহরে চট্টগ্রাম আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন এই সময়ের সাহসী নারী জিনাত সোহানা চৌধুরী।