ছড়িয়ে পড়া বিপদের নাম প্লাস্টিক বর্জ্য : সুব্যস্থাপনা জরুরি

32

ফজলুর রহমান

“যদি আমি ভুল না করে থাকি, আমার এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে।“ এই কথাটি বলেছিলেন বিজ্ঞানী লিও হেনরিক। এটা ১৯০৭ সালের ১১ জুলাই এর কথা। যখন ৪৩ বছর বয়সী বিজ্ঞানী লিও হেনরিক নতুন এক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন। একটি জার্নালে নিজের সদ্য উদ্ভাবিত এই পদার্থ নিয়ে গর্ব করেছিলেন লিও হেনরিক। সেদিনের সেই লিও হেনরিক-এর উদ্ভাবন এর নাম ছিল ‘প্লাস্টিক’।
এই একই উপাদানের হাজারটা ব্যবহার আছে, এমনটাও বলেছিলেন লিও। প্রথম থেকেই দেখি। গবেষকদের মতে, প্লাস্টিকের পূর্বে রাজত্ব করা সেলুলয়েডকে সরিয়ে দিয়ে সে জায়গা দখল করে প্লাস্টিক। টেলিফোন, বন্দুক, কফি মেকার- সবকিছুতেই একটু একটু করে প্রবেশ করে প্লাস্টিক। এ সময় মানুষের মধ্যে চিন্তা ভাবনা শুরু হয় প্রকৃতিতে নেই এমন উপাদান তৈরি করার। ফলে ১৯২০-১৯৩০ এর মধ্যে প্লাস্টিক গবেষণাগার থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় প্লাস্টিক ছিল পলিস্টিরিন, পলিথিলিন ও নাইলন আকারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষ প্লাস্টিকের ওপর অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের পরে জন্ম নেয় টাপারওয়্যারের মতো নতুন সব পণ্য। তখন প্লাস্টিক নতুনত্ব আর নতুন সম্ভাবনার প্রতীক ছিল। এর এখন!
বর্তমানে জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার হয় প্যাকেজিংয়ে। এ খাতে প্রায় ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ, বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনে ব্যবহার হয় ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ, অটোমোবাইলে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ইলেকট্রনিক্সে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কৃষিতে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। বছরে বিশ্বে ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন করা হয়। দুনিয়াজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয়। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে প্রতিবছর এক কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়।
প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয়। এটি পানিতেও মিশে যায় না। ফলে প্রাণীদের উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে আনা থেকে শুরু করে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসে প্লাস্টিক। প্লস্টিকের ক্ষতিকারক দিকের কারণে একজন মানুষের নানা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাও তৈরি হয়।
গবেষকদের মতে, এক বছরে সমুদ্রে যে পরিমাণ প্লাস্টিক জমা হচ্ছে তা চার বার পৃথিবী ঘুরে আসতে পারবে এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়ার আগে এটি এক হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী অবস্থায় থাকতে পারে। প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হয়। সমুদ্রে প্লাস্টিক অতি ক্ষুদ্র
টুকরায় ভেঙ্গে যায়। এসব টুকরা মাছও খায়, কিন্তু হজম হয় না। মাছের পেটে জমা হতে থাকে এবং তা খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে। প্রতি বছর আট মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পড়ার ফলে অন্তত আট বিলিয়ন ডলারের সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আনুমানিক এক মিলিয়ন সামুদ্রিক পাখি, এক লক্ষ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী ও অবর্ণনীয় সংখ্যক মাছ মারা যাচ্ছে।
ইকোনমিস্ট এর প্রতিবেদন মতে, ১৯৫০ দশক থেকে ৬.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। যার ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা এবং ১২ শতাংশ পোড়ানো হয়েছে। বাকি বর্জ্য ভূমি ভরাট বা প্রাকৃতিক পরিবেশে ফেলা হয়েছে।
পলিথিন বর্জ্য নালা-নর্দমা, খাল গিয়ে সেগুলোকে বøক করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টিকারী প্লস্টিকের বোতল, বিভিন্ন সামগ্রী ও পলিথিন ব্যাগের অধিকাংশই পুনর্ব্যবহার, পুনঃচক্রায়ন না করে প্রাকৃতিক পরিবেশে যত্রতত্র ফেলা দেয়া হচ্ছে। যা পরবর্তীতে খাল, বিল, নদী, সমুদ্রে জমা হচ্ছে। সেখান জলজ প্রাণী তা গ্রহণ করছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমে তা খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাবে জনজীবন, জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্যসহ জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। প্লাস্টিক দূষণ আমাদের নদী, সাগর, মহাসাগর ও ভূমিকে বিষাক্ত করছে, সামুদ্রিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করছে, এবং জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রে যে হারে প্লাস্টিক বাড়ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে
প্রবাল প্রাচীরের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির পর দ্বিতীয় বড় হুমকিটি প্লাস্টিক বর্জ্য, যা প্রবাল প্রাচীরের রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২০ গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আবার, প্লাস্টকের আছে
কিছু ভালো দিকও। এই যে বড় বড় গাড়ি চলছে পথে, প্লাস্টিকের ব্যবহার হয় বলেই এরা এত হালকা হতে পারে এবং জ্বালানি খরচ কমে আসে। ভঙ্গুর গ্যাসের বদলে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করাটা নিরাপদ।
প্লাস্টিক সাধারণত পেট্রোলিয়াম বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উদ্ভূত হয়, এই প্লাস্টিক বর্জ্যে যে পরিমাণে সঞ্চিত শক্তি রয়েছে তা অন্য কোনও বর্জ্যের তুলনায় বেশি পরিমাণে সঞ্চিত শক্তি দেয়। প্লাস্টিককে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে কিছু শক্তি ফিরে আসে। তাই প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরী, উল্লেখযোগ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি করে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। যদি এই প্রকল্পটি সারাদেশের পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে করা হয় তাহলে বর্জ্য অনেকাংশে কমে যাবে। এতে দেশের জ্বালানি চাহিদা কিছুটা মেটানো সম্ভব হবে। এছাড়াও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বর্জ্যের কিছু অংশ পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্জ্য পুড়িয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ বর্জ্য কমিয়ে ফেলা সম্ভব। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সাল নাগাদ প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার ৩০ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশে উন্নীত করার ‘প্লাস্টিক কৌশল’ গ্রহণ করেছে। ২০১৫ সালে বিৃটেনে প্লাস্টিক শপিং ব্যাগে কর বসানোর ফলে এর ব্যবহার ৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এখন জরুরি ভিত্তিতে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যেও ব্যবহার, প্রচার- প্রসার বাড়াতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করতে হবে। আমাদের দেখিয়ে দিতে হবে কিভাবে প্লাস্টিক পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণ করা যায় এবং উদ্ধার করা উপকরণগুলিকে দ্বিতীয় বারের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে, এটি এমন প্লাস্টিক যা জীবের ক্রিয়া দ্বারা পঁচে যায়। বিশেষত, যে সকল প্যাকেজিং জৈব বর্জ্য থেকে সহজে পৃথক করা যায় না, সেখনে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ব্যবহার করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা রয়েছে। বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগ শেষ পর্যন্ত উদ্ভিদ পদার্থের মতোই পঁেচ যায়। বায়োপ্লাস্টিক ফয়েল সহজে ছেঁড়ে না, তার ওপর ছাপ মারা যায় এবং মেশিনে কাটছাঁট করা যায়। বায়োপ্লাস্টিক তৈরিতে অনেক কম ধাতব কিংবা খনিজ পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগে রান্নাঘরের অর্গানিক জঞ্জাল জমিয়ে সবটাই নির্দিষ্ট অর্গানিক আবর্জনার জায়গায় ফেলা যায়।
এছাড়া প্লাস্টিকের বিকল্প হতে পারে পাট, তুলার মতো পরিবেশবান্ধব পণ্য। এসব রিসাইকেল করাও সম্ভব। পাটের, তুলার তৈরি ব্যাগ দেখতে সুন্দর, আধুনিক ও মজবুত। এই ব্যাগ ব্যবহারে যেমন আর্থিক সাশ্রয় হবে, তেমনি পরিবেশ সুরক্ষাও হবে।
বাজার সংস্কৃতির যুগে আমরা। সকালে জানালা খুলে আকাশ দেখার আগে দেখছি বাজার। সকালে প্রথমেই হাতে পড়ছে প্লাস্টিকের টুথব্রাশ, টুথপেস্ট টিউব। যে প্লাস্টিক ক্ষয় হতে পাঁচশ’ বছর পর্যন্ত সময় লাগে! অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাস্টিক বর্জ্য চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই দূষণ প্রতিরোধ করতে, প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো সম্পদে রূপান্তর করতে প্রত্যেক স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ খুব দরকার। নয়তো আরো ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হতে পারে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। এরইমধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেস একটি গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে বলেছেন, “২০৫০ সালের মধ্যে যদি কিছু করা না হয়, তাহলে প্লাস্টিকের পরিমাণ মাছের চেয়ে অধিক হতে পারে।”

লেখক : কলামিস্ট, উপ-পরিচালক
(তথ্য ও প্রকাশনা) চুয়েট