ছোবল মারতে শক্তি সঞ্চয় করছে ‘ফণি’

146

দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’র শক্তি সঞ্চয়ের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়ার মধ্যেই এবার ফিরে এলো ভয়াল ২৯ এপ্রিল। আটাশ বছর আগে ১৯৯১ সালের এইদিনে স্মরণকালের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’-এর ভয়ঙ্কর ছোবল আর ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-সন্দ্বীপ-হাতিয়াসহ আশপাশের সমুদ্র উপকূলে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ও কয়েক লাখ গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে। অন্তত এক কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে আর্থিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার বলে ধারণা করা হয়। প্রাণহানির সংখ্যা ও সম্পদহানির পরিমাণে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড় একটি। এদিকে, ভারত মহাসাগর হয়ে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ফণা তোলা ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’ ছোবল মারার জন্য নিজের শক্তি বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। গতকাল রবিবার রাত টায় ঘূর্ণিঝড় ফণি দেশের মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার চারশ’ ৭৭ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় একশ’ সাত কিলোমিটার আর গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার। এটি আরও শক্তিশালি হয়ে ‘সুপার সাইক্লোন’ বা অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে (৫-৬ মে) শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আকারে ফণি দেশের চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূল কিংবা এর আশেপাশের এলাকা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক স্বাক্ষরিত বিশেষ বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ আরও উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৬২ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর উত্তাল রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমূদ্রবন্দরসমূহকে দুই দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
অপরদিকে, গ্রীষ্মের শুরু থেকেই দেশজুড়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ অধিকাংশ এলাকায় এখনও সক্রিয় থাকলেও ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর অঞ্চলের প্রায় সব এলাকায় গতকাল রবিবার কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে স্বস্তির সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে বৈশাখের নিয়মিত বৃষ্টিধারা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে সিলেটে। আর নববর্ষে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় রবিবার সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাঙামাটিতে। এছাড়া, চট্টগ্রাম সদরসহ বিভাগের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৫ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই উঠানামা করেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগামী ৪৮ ঘন্টায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না থাকলেও বর্ধিত পাঁচদিনের আবহাওয়ার অবস্থায় বৃষ্টিপাতের কার্যশক্তি বৃদ্ধি পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবহাওয়া গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংস্থার নথিপত্র এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় দুইশ’ ৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ছয় মিটার অর্থাৎ ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় এবং এতে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, স›দ্বীপ, কক্সবাজারের মহেশখালী এবং নোয়াখালির হাতিয়ায় নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। এর মধ্যে শুধু সন্দ্বীপে প্রাণহানি ঘটে ২৩ হাজার মানুষের। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে কর্ণফুলী নদীর তীরে কংক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের একশ’ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট-বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। ঘুর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ ক্যাটাগরি-৪ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে ধ্বংসলীলা চালানোর পর এর ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে পরদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই ঘুর্ণিঝড়ের দুঃসহ স্মৃতি উপকূলের মানুষ আজও ভোলেনি। প্রতিবছর কালবৈশাখীর মৌসুম এলেই উপকূলের মানুষের মনে অজানা শঙ্কা ভর করে।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী দেশি-বিদেশি একাধিক সংস্থার ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ফণি প্রথমে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতের তামিলনাড়–র কাছাকাছি হয়ে পশ্চিমা জেট বায়ুর কারণে গতিপথ পরিবর্তন করে, ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করলে সেসময় তার প্রভাবে দেশের আকাশ মেঘলা থেকে মেঘাছন্ন থাকতে পারে। বঙ্গোপসাগর তখন প্রচন্ড উত্তাল থাকবে। এখন পর্যন্ত ঘুর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে আবহাওয়াবিদরা যেটা ধারণা করছেন তা হল, ঘূর্ণিঝড় ফণি ক্যাটাগরি ৪ বা ৫ ক্ষমতাসম্পন্ন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আকারে দেশের বরিশাল ও চট্টগ্রাম উপকূলের ভেতরে ছোবল মারতে পারে। যেখানে বাতাসের গড় গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় একশ’ ৮০ থেকে দুইশ’ ৬০ কিলোমিটার থাকতে পারে। এমন শক্তির ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে উপকূলে নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে। তবে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে ঘূর্ণিঝড়ের বিদায়ের পর শুরু হতে যাওয়া পবিত্র রমজানে রোজাদারদের অস্বস্তির অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে তাপদাহ। পুর্বাভাসেই এমন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। পুরো মে মাসজুড়েই দেশের অধিকাংশ এলাকায় দাপট থাকবে তাপদাহের। মাসের শেষের দিকে দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য স্থানে এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টির আলামত রয়েছে, যার একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।