ছোট্ট উদ্যোগ বিস্তৃত সফলতা

102

ছদ্মনাম আরিফ। বাবা দিনমজুর ও মা গৃহিনী। মা-বাবা উভয়ের লেখাপড়া ৩য় বা ৪র্থ পর্যন্ত। বাবা যেদিন কাজ করেন যেটুকু আয় করেন তা দিয়ে তাদের দিন চলে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আরিফ বড়। তার বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন সে ৩য় শ্রেণিতে। সকাল নয়টায় বিদ্যালয়ে আসত, বেলা সোয়া বারোটায় বাড়ি ফিরত। এদিকে আরো ৩টা বই নতুন যোগ হলো। সাথে সোয়া বারোটা থেকে সোয়া চারটা পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করা। এছাড়া রয়েছে চারু-কারু, সংগীত, শারীরিক শিক্ষা, সহ-শিক্ষা ক্রমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। তার শ্রেণির পঞ্চম পিরিয়ডে আমি প্রাথমিক বিজ্ঞান পড়াতাম। প্রায়ই দেখা যেত সে পড়া এবং লেখায় অমনযোগী।
অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে কিছুতেই তাল মিলাতে পারত না। বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে তার মাসিক মূল্যায়ণ ও প্রথম সামায়িক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ণ করি তাতে তার ফলাফল হতাশাব্যঞ্জক। পরবর্তীতে তার বিষয়ে আলোচিত হল স্টাফ কাউন্সিলে। শ্রেণি শিক্ষক তার ব্যাপারে ব্যক্ত করলেন, এক দুঃখজনক ঘটনা। প্রথমত, অস্বচ্ছল পারিবারিক অবস্থা, দ্বিতীয়ত তার পিতামাতার অসচেতনতা। সে সকালে বাড়ি থেকে যা খেয়ে আসত তা দিয়ে তার পুরো দিন শেষ হতো। এ তথ্য পাওয়ার পর তাকে নিয়ে ভাবি। মনে পড়ে যায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘হে মহাজীবন’ কবিতার দুটি চরণ :
“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়ঃ
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”
এবার পরীক্ষণ কার্য শুরু করি। নিজের জন্য আনা খাবার থেকে আরিফকে ভাগ দিই। পরপর কয়েকদিন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পড়ালেখার প্রতি তার সক্রিয়তা যাচাই করি। সফলতা পরিলক্ষিত হলো। এবার কথা বললাম তার বাবা-মায়ের সাথে। মা- বাবা তাদের দূরবস্থার কথা ব্যক্ত করলেন। এরপর বিদ্যালয় ভিত্তিক ক্ষুদ্র উন্নয়ন পরিকল্পনা (কাইজান) প্রকল্পের আওতায় যারা স্বচ্ছল তাদের সাথে আলোচনা করে কারো কাছ থেকে পাঁচটি, কারো কাছ থেকে দশটি করে টিফিন বক্স সংগ্রহ করা হয় এবং তাদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয় আরিফের মত একশ বিশ জন শিক্ষার্থীর মাঝে। এর ফলে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে তৈরি হল অন্যরকম এক ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার সেতুবন্ধন।
উঠান বৈঠক, মা সমাবেশ ও অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে কর্মরত সকল শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিভাবক শিক্ষক কমিটির সহযোগিতায় এ ব্যাপারে জোর দেওয়া হলো। ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসার সময় দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে খাওয়ার জন্যে নিয়ে আসবে কিছু খাবার। ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হলো আরিফের বাবা-মায়ের সাথে তাদের বোঝানো হলো আরিফের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ। মাকে বললাম “আপনার যে টুকু সাধ্য হয় তা দিয়ে তার টিফিন বক্সে দিবেন।” তিনি রাজি হলেন। আরিফের চোখে দেখা গেল আশার আলো। নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, তার পড়ালেখায় আগ্রহ ও উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
এগিয়ে চলি সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের দিকে। ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির – শিক্ষক সহ কর্মরত প্রত্যেক শিক্ষক শ্রেণিতে ২/১ মিনিট দুপুরে যাতে প্রত্যেকে খাবার নিয়ে আসে সে ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। সাথে এ শিক্ষাও দিতেন একজন আরেকজনের সাথে দুপুরে খেতে বসলে কিভাবে আন্তরিকতা হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন অনেক বাবা-মা, ভাই-বোনা, চাচা-চাচী, মামা-মামী, নানা-নানী অথবা শিক্ষার্থী নিজেই বিদ্যালয়ে আসার সময় সাথে নিয়ে আসছে দুপুরের খাবার। বর্তমানে বিদ্যালয়ে টিফিন পিরিয়ডে বিরাজ করে এক উৎসব মুখর পরিবেশ। যারা দুপুরে শিক্ষার্থীদের জন্যে নিয়ে আসে তারা ফাঁকে শিক্ষকদের সাথে দেখা করে শিক্ষার্থী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য শিক্ষকগণের সাথে আলাপ করছে। যা শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণে যুগান্তকারী মাইলফলক।
কেননা অভিভাবকগণ পুর্বের তুলনায় বর্তমানে বিদ্যালয়মুখী ও শিক্ষার অগ্রগতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অবগত হতে পেরে নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এখন আর মনমরা হয়ে থাকতে হচ্ছে না। অভিভাবকগণ ও বেশ খুশি। কারণ এখন শিক্ষার্থীদের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হচ্ছে না। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে আসার সময় টাকা দেওয়ার মিথ্যা বায়না থেকে ও বেঁচে যাচ্ছেন।
২০১৮খ্রি: মীনা দিবসের স্লোগান: “মায়ের দেওয়া খাবার খাই, মনের আনন্দে স্কুলে যাই”।
এভাবে শুরু হল ‘মিড ডে মিল’ কার্যক্রম সরকারি উদ্যোগে। গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। শিক্ষার মান উন্নয়নে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির পাশাপাশি সরকার ও বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির যৌথ উদ্দ্যোগে দেশে প্রথম ‘মিড ডে মিল’ প্রবর্তন করা হয় বরগুনা জেলার ইসলামপুর উপজেলায়। পরবর্তীতে সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠার সহযোগিতায় ‘মিড ডে মিল’ কার্যক্রম ব্যাপকতা লাভ করে। এপর্যন্ত দেশের ৯২টি বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে মিল’ চালু আছে। সরকারের এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এর ফলে শিশুরা অপুষ্টির হাত থেকে বাঁচে। বিদ্যালয় মুখী হয়। ঝড়ে পড়ার হার কমে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বত: স্ফুর্ততা ও পড়ালেখার মনোযোগ বাড়ে। সর্বোপরি ‘মিড ডে মিল’ শিশুর সুস্বাস্থ্য গঠনে অপরিসীম অবদান রাখে। এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো- ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ । কিন্তু সময় পাল্টে গেছে।
এখন বাংলাদেশকে বিশ্বের অনেক দেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখে। উদীয়মান ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম ও রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা তৈরিতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে এদেশ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি দেশ। ক্ষুধা ও অপুষ্টিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন সৃজনের মাধ্যমেই আমরা অর্জন করবো মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সহজ ও তরান্বিত করবে। সেই সাথে অর্জিত হবে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য। শারীরিক শিক্ষার ভাষায় বলতে হয়- “সুস্থ দেহে, সুন্দর মন”। একজন সুস্থ মানুষ একজন ধনী ব্যাক্তির চেয়ে অনেক বেশি সুখী। শিশুর শারীরিক বিকাশ যদি স্বাভাবিক থাকে তবে তার মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আবেগিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশও স্বাভাবিক থাকবে। ফলশ্রুতিতে তাদের দেশাত্মবোধ, সৃজনশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হয়ে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তবেই তারা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ হবে। “মিড ডে মিল” নামক সরকারের গৃহীত এই মহতী উদ্যোগ বা কার্যক্রমকে শতভাগ সফলকরে তোলার জন্যে আসুন সকলে একযোগে কাজ করি। দেশের সকল শিক্ষাঙ্গন হোক ক্ষুধামুক্ত এই প্রত্যাশা করি।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, বাঁশখালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়