‘ছেলে ধরা’

37

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী

দুইজন শিশু পুত্রকে চেম্বারে দেখাতে আসা। কিন্তু তাদের ভগ্নস্বাস্থ্যের খোঁজে যে ইতিহাস, তার গল্পটা এরকমÑ জেলে পল্লিটা সমুদ্র সৈকতের ধারে। অবারিত বালুকাভ‚মি। মা-বাবা কাজে থাকলে দুই ভাই ওখানে দিনভর খেলা করে। মা বরাবরের মতো রান্না-বান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সংসারে কি কাজের অভাব আছে! কত রকমের কাজ। গরু-ছাগল পালন, গোবরের গুটি শুকানো, উনুনের লাকড়ি থেকে বাসন-কোসন মাজার ছাই পর্যন্ত হিসাবে রাখতে হয়। বাবা মানিক সরকার নির্মাণ শ্রমিক। কাছাকাছি এলাকায়। দুপুরের খাবারের সময়ে তাঁদের দুই ছেলেকে ডেকে সাড়া পেলেন না। শুরু হলো খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কাছের জলাশয়ে, ঝোপে-ঝাড়ে-ধু ধু সমুদ্রপাড়ে। আত্মীয়-পরিজন-পাড়া-প্রতিবেশি সবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তপ্ত হয়ে ওঠে। মা পাগলিনী প্রায়। মানিক সরকার কার মুখে যেন ছেলেধরার কথা অনুমান করে নিলেন। ছুটতে লাগলেন এদিক-ওদিক, মা গেলেন গাছাবাড়ি-মাজারে মানত রাখতে। কারো সূত্র ধরে চলে যান রামগড়। কোনো সন্ধান মেলেনি। অর্ধাহার, অনাহার অভুক্ত থেকে যেন পা আর চলে না। ক্লান্ত বিপর্যস্ত। কাছে ছোট নদীতে একটা ডুব দিয়ে মন হালকা করতে চাইলেন তিনি। হঠাৎ যেন নজরে পড়লো দুই শিশুকে নিয়ে একটা লোক সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে যাচ্ছে। মানিক সরকার রাজু, সাজু বলে ডাক দিলেন। যত শক্তি আছে নিঃশেষ করা বিকট চিৎকারে। ছেলে দুটোও পেছনে তাকিয়ে কান্নার শব্দে উত্তর দিলো- ‘বাবা’। হাঁটু জল ভেঙে ধাওয়া করলেন ছেলে-ধরাকে। ছেলেধরা দুই শিশুকে তৎক্ষণাৎ জলে ছুঁড়ে দেয়। মানিক তাড়াতাড়ি দুই পুত্র সন্তানকে আগে উদ্ধার করেন। ইতোমধ্যে ছেলেধরা ওপারে দ্রুত সটকে পড়ে। অনেক লোকজন এসে জটলা শুরু করে দিল। স্থানীয়রা মানিক সরকারকে ছেলেধরা ভেবে পিটাতে লাগলেন। তার কোনো কথা কেউ কর্ণপাত করছে না। রক্তাক্ত তিনি। অবশেষে এক বয়স্কজনের পরামর্শে তাঁকে আর মারধর না করে থানায় সোপর্দ করা হয়। পুলিশ অফিসার জানালেন, শিশুর মা’কে হাজির করাতে হবে। মা আসলেন। তিনি তখন দুই শিশু পুত্রকে হারিয়ে উম্মাদিনী। মাথার চুল জট পাকানো। ছিন্ন বস্ত্র, ছেলে দুটো তাঁদের মাকে চিনতে পারলো না সহসা। তাদের মনে ছেলেধরা ভীতি এখনো যায়নি। মাকে দেখে বরং দূরে সরে গেলো ছোট্ট শিশু দুইজন। তখন পুলিশ কর্মকর্তা মানিক সরকারকে জানান, এতো তাড়াতাড়ি সন্তান দুটোকে এভাবে দেওয়া যাবে না। কোর্টে চালান দিতে হবে। ছেলে দুটো কারাগারের তত্ত¡াবধানে থাকবেন আর মানিক সরকার ততদিন বন্দী থাকবেন। টানা ছয় বছর মামলা চললো। অবশেষে একদিন প্রমাণিত হলো মানিক সরকার এই দুই শিশু পুত্রের বাবা। ছেলেধরা নন।

লেখক: প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।