চোরের নজর গোয়ালঘরে

30

তুষার দেব

চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় গরু চোরের উপদ্রব বেড়েছে। গত কয়েক মাসে সাধারণ কৃষকের পালিত শতাধিক গরু চুরির শিকার হয়েছে। গরু চুরি এখন নিরাপদ কারবারে পরিণত হয়েছে। প্রাইভেট কারে পুলিশের স্টিকার লাগিয়ে গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। কোনও কোনও এলাকায় গরুচোর আতঙ্কে রীতিমত পাহারা বসানো হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে বর্তমানে চোরের নজর বসতঘরের চেয়ে গোয়ালঘরের দিকেই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত তিন মাসে দুই শতাধিক গরু চুরি হলেও অধিকাংশ গরুর কোনও হদিস মিলেনি।
পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবাদি পশুর মধ্যে বিশেষ করে গরু চুরিতে ঝক্কি-ঝামেলা কম। প্রায় সব গেরস্থ-বাড়িতে গরু রাখার জন্য আলাদা ঘর থাকে। রাতের আঁধারে নিঃশব্দে গরুকে ঘর থেকে বের করে আনা তুলনামূলক সহজ। থানায় গরু চুরির মামলা-মোকদ্দমা রেকর্ড করার রেওয়াজও কম। জীবিত ও মৃত-উভয় অবস্থায় গরু বিক্রি করা যায়। এসব কারণে চোরের দল গরু চুরিকেই তুলনামূলক নিরাপদ মনে করছে।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) সুদীপ্ত সরকার পূর্বদেশকে বলেন, যে কোনও অপরাধের প্রতিকার পেতে চাইলে তো ভুক্তভোগীকে মিনিমাম অভিযোগ করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে গরু চুরির বিষয়ে চন্দনাইশ ও সীতাকুন্ড থানায় মামলা হয়েছে। গরু চুরিতে জড়িত বেশ কয়েকজন ধরাও পড়েছে। এ অপরাধে জড়িত অন্যান্যদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের সংশ্লিষ্টদের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বর থেকেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গরু চুরির হিড়িক পড়েছে। এমনকি প্রাইভেট কারে পুলিশের স্টিকার লাগিয়ে গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৮ জানুয়ারি ভোররাত চারটার দিকে জেলার অপরাধপ্রবণ সীতাকুন্ড এলাকায় প্রাইভেট কারে পুলিশের স্টিকার লাগিয়ে গরুর বাছুর চুরি করে পালানোর সময় গণধোলাই দিয়ে দুই জনকে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। তারা হলেন, সীতাকুন্ড উপজেলার বাসিন্দা শাওন দাশ (২২) ও আমির হোসেন (১৯)। এ সময় তাদের সাথে থাকা আরও দুই জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশে গত তিন মাসে ২৯ গরু চুরি হয়েছে। গরু চুরির ঘটনায় সন্দেহভাজন ১৮ জন আটক করা হয়েছে। এত গরু চুরির পরও থানায় মামলা রেকর্ড হয়েছে মাত্র দুটি। ভুক্তভোগীরা গরু চুরির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ হলেও আইনি প্রতিকার পেতে আগ্রহ বোধ করেন না। এ উপজেলায় গত বছরের নভেম্বর থেকে গত ২৫ জানুয়ারি সময়ের মধ্যে ২৯টি গরু চুরি হয়। উপজেলার কাঞ্চননগর আব্বাস পাড়া এলাকায় গত ৯ নভেম্বর দিবাগত গভীর রাতে চোরের দল কাঞ্চননগর আব্বাস পাড়ার কৃষক কোরবান আলীর গোয়ালঘরের দরজার তালা কেটে প্রবেশ করে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দামের দু’টি ষাঁড়, ৬০ হাজার টাকা দামের ১একটি গাভী, একই এলাকার আজিম উদ্দীনের আড়াই লাখ টাকা দামের দু’টি গাভী, এক লাখ ১০ হাজার টাকা দামের দু’টি বাছুর চুরি করে নিয়ে যায়। গত ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে হারলার রমজু বলি বাড়ির কৃষক আবদুল আলীমের চারটি দুধেল গাভী, একটি বাছুরসহ চোরের দল পাঁচটি গরু চুরি করে নিয়ে যায়। এসব গরুর আনুমানিক বাজারমূল্য আট লক্ষাধিক টাকা হতে পারে। এ ব্যাপারে গরুর মালিক আব্দুল আলীম বাদী হয়ে চন্দনাইশ থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করলে পুলিশ পৌরসভা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত ২৬ নভেম্বর রাতে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গত ৮ ডিসেম্বর ভোর রাতে থানা সংলগ্ন ফতে মোহাম্মদ চৌধুরী বাড়ির শামসুল ইসলাম চৌধুরীর গোয়ালঘরের তালা ভেঙ্গে একটি বিদেশি জাতের গাভী, একটি ষাঁড় চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় তার ছেলে মাসুদ পারভেজ দেখতে পেয়ে চিৎকার দেয়। এ সময় লোকজন এগিয়ে আসতে দেখে চোরের দল বাছুর ফেলে গেলেও গাভীটি নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে শামসুল ইসলাম চৌধুরী বাদি হয়ে চন্দনাইশ থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। গত ৭ জানুয়ারি গভীর রাতে চোরের দল দোহাজারী পৌরসভার পূর্ব হাছনদন্ডী কলার বাড়ির হারুনুর রশিদের গোয়ালঘরের তালা ভেঙে একটি গাভী, দু’টি ষাঁড় এবং পার্শ্ববর্তী গিয়াস উদ্দিনের একটি গাভী চুরি করে নিয়ে যায়। গত ২০ জানুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে চোরের দল চন্দনাইশ সদরের হাজির পাড়ার চাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মিয়ার গোয়ালঘরের তালা কেটে ২ লাখ টাকা দামের দু’টি ষাঁড়, দেড় লাখ টাকা দামের দু’টি গাভী, পার্শ্ববর্তী রৌশন আকতারের গোয়ালঘর থেকে দেড় লাখ টাকা মূল্যের দু’টি গাভী চুরি করে নিয়ে যায়। পরদিন গত ২১ জানুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে চোরের দল উপজেলার হাশিমপুর মোজাহের পাড়ার আবদুল গফুরের গোয়ালঘর থেকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দামের দু’টি ষাঁড় চুরি করে নিয়ে যায়।
একইভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আরেক উপজেলা আনোয়ারায় যেন গরু চুরির হিড়িক পড়েছে। প্রায় প্রতি রাতেই ঘটছে গরু চুরির ঘটনা। এতে গরু মালিকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চলতি জানুয়ারি মাসের ২৫ দিনে উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নে গুয়াপঞ্চক, আমান উল্লাহপাড়া, চাতরীর ডুমুরিয়া, পরৈকোড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ২০ থেকে ২৫টি গরু চুরির ঘটনা ঘটেছে। গত ২০ জানুয়ারি রাতে উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের গুয়াপঞ্চক ফজু তালুকদার বাড়ি ও আমান উল্লাহপাড়া এলাকা থেকে চারটি গরু চুরি হয়েছে। এর মধ্যে বৈরাগ ইউনিয়নের গুয়াপঞ্চক ফজু তালুকদার বাড়ির মোহাম্মদ সরোয়ারের দু’টি, দানা মিয়ার একটি ও আমান উল্লাহপাড়া থেকে দু’টি গরু চুরি হয়। এর আগের রাতে পরৈকোড়া ইউনিয়নের মামুর খাইন এলাকায় বরকত উল্লাহ চৌধুরীর বাড়ির আবুল কালাম ও বদরুল হক নামে দুই ব্যক্তির গোয়াল ঘর থেকে দু’টি গরু চুরি হয়। চুরি যাওয়া ছয়টি গরুর আনুমানিক বাজারমূল্য পাঁচ লাখ টাকা বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্তদের।
আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর্জা মুহাম্মদ হাছান বলেন, গরু চুরির খবর শুনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। চুরির ঘটনা ঘটলেও অনেকে থানায় অভিযোগ করেন না। যার কারণে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়না। চুরির ঘটনা ঘটলে থানাকে অবগত জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
অপরদিকে উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় প্রতিরাতেই কোনও না কোনও এলাকায় হানা দিচ্ছে সংঘবদ্ধ গরু চারের দল। উপজেলায় গত কয়েক মাস ধরে প্রায় রাতেই গরু চুরির ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত তিন মাসে ১৬টিরও বেশি গরু চুরি হয়েছে। রাঙ্গুনিয়া থানায় একাধিক গরু চুরির অভিযোগ জমা পড়লেও পুলিশ চুরি যাওয়া গরু জব্দ বা চোর গ্রেপ্তার- কোনওটিই করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
তবে রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব মিল্কী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, থানায় গরু চুরির একাধিক অভিযোগ আমরা পেয়েছি। সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা রাতে পুলিশ টহল এবং অভিযান অব্যাহত রেখেছি। সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজনকে আটক করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।