চেনা পরিবারটিতে হঠাৎ অচেনা কাহিনী

49

আবেদ আমিরী, পটিয়া

চট্টগ্রামের রাজনীতিতে শামসুল আলম মাস্টার একটি অনন্য নাম। ব্যাপক পরিচিত জাতীয় পার্টির এ নেতার নাম উচ্চারিত হয় পটিয়াবাসীর মুখে মুখে। তার হাত ধরে পটিয়া পৌরসভায় হয়েছে অনেক নতুন রাস্তাঘাট ও নানা স্থাপনা। পটিয়ার যেকোন সমস্যা সমাধানে তিনি ছিলেন অগ্র সৈনিক। ‘পাগলা সামশু’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন।
গত ১৩ জুলাই বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার পরিবারের প্রতি পটিয়াবাসীর রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কিন্তু গত মঙ্গলবার সেই শামসু মাস্টারের পুত্র মাইনুল বাবার রেখে যাওয়া টাকার জন্য মা জেসমিন আকতারকে গুলি করে হত্যা করেন। এতে হঠাৎ যেন অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো আলোকিত পরিবারটি। চেনা পরিবারটিতে সংঘটিত এ ঘটনাকে হঠাৎ অচেনা কাহিনী বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। গতকাল বুধবার ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে নামাজে জানাজা শেষে শামসু মাস্টারের কবরের পাশে স্ত্রী জেসমিন আকতারকে দাফন করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, বাবা শামসু মাস্টারের দেখানো আলোকিত পথে হাটেননি পুত্র মাইনুল। তার বিচরণ ছিলো অন্ধকার জগতে। তারা জানান, পটিয়ার মানুষের সঙ্গে শামসু মাস্টারের সম্পর্ক ছিলো মধুর। পটিয়ার সর্বস্তরের মানুষ তাকে ভালোবাসতেন। তিনি পটিয়া পৌরসভার সৃষ্টির পর ১৯৯৩ সালে প্রথম নির্বাচনে ও ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
মাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মাইনুলের বোন শায়লা শারমীন নিপা। ঘটনার বিষয়ে তিনি জানান, মাইনুল অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতেন। বাবার মৃত্যুর পর মাইনুল বেপরোয়া হয়ে উঠেন। বাবার টাকার জন্য খুনের প্রথম টার্গেট ছিলেন শায়লা শারমীন নিপা। প্রথম ছোড়া গুলি লক্ষভ্রষ্ট হলে নিপা দরজা বন্ধ করে একটি কক্ষে আত্মরক্ষা করেন। এরপর দ্বিতীয় গুলি ছোড়া হলে তা মায়ের চোখের নিচ দিয়ে বিদ্ধ হয়।
তিনি জানান, তার বাবা পটিয়া পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল আলম মাস্টার গত জুলাই মাসে মৃত্যুবরণ করেন।তিনি মৃত্যুকালে দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। ভাই মাইনুল চট্টগ্রাম শহরের বাসায় বাসবাস করতেন। মেয়ে শায়লা শারমীন নিপা ও ছোট ছেলে মাশফীর আলম অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। তারা দু’জনই গত ঈদের ছুটিতে পটিয়ার বাড়িতে বেড়াতে আসেন।
এরই মাঝে তাদের বাবা শামসু মাস্টার গত ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত ২২ জুলাই অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি। পরে ছোট ভাই মাশফীর স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ায় গত ৮ আগস্ট সে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়।
শায়লা শারমীন নিপা জানান, পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির প্রতি মাইনুলের স্ত্রী আসিফা সুলতানার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। পিতার সম্পত্তি এককভাবে ভোগ করার জন্য মাইনুলের স্ত্রী প্রায় সময় মাইনুলকে কুপরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। ব্র্যাক ব্যাংক পটিয়া শাখায় শামসু মাস্টারের একাউন্টে ১৩ লাখ টাকা ছিল। সেখানে তিনি নমিনি ছিলেন। জনতা ব্যাংক পটিয়া শাখায় আরেকটি একাউন্টে ছিল ৩ লাখ টাকা। ওই একাউন্টের নমিনি ছিলেন মা। এসব টাকা তোলার জন্য গত মঙ্গলবার বেলা ১২ টার দিকে শায়লা শারমীন নিপা ও মা জেসমিন আকতার ব্যাংকে যান। কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা তোলার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় পৌনে ১ টার দিকে তারা বাসায় ফিরে আসেন। বাসায় পৌঁছার পর তারা বাংকে যাওয়ার খবর পেয়ে দুপুর দেড়টার দিকে ক্ষুব্ধ অবস্থায় বাড়িতে আসেন মাইনুল। এরপর তাকে না বলে ব্যাংকে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। এক পর্যায়ে মাইনুল কোমরে থাকা পিস্তল বের করে তাকে (শায়লা শারমীন নিপা) লক্ষ্য করে গুলি করেন। গুলি লক্ষভ্রষ্ট হলে তিনি বেচে যান। পরবর্তীতে মা জেসমিন আকতারকে সামনে পেয়ে গুলি চালান। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। ঘটনার পর মাইনুল পালিয়ে যান। মঙ্গলবার রাতেই বোন শাইলা শারমীন নিপা বাদী হয়ে মাঈনুলের বিরুদ্ধে পটিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
উল্লেখ্য, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১০ রাউন্ড কার্তুজ ও ১ টি এয়ারগান, ব্যবহৃত ও অব্যহৃত দুটি গুলি উদ্ধার করে।
এদিকে শামসুল আলম মাস্টারের লাইসেন্স করা শর্টগান ও মায়ের খুনে ব্যবহৃত অবৈধ পিস্তলের খোঁজ পায়নি পুলিশ। লাইসেন্স করা শর্টগানের খোঁজে পুলিশ দক্ষিণ জেলা জাপার কার্যালয়ে তল্লাশি করলেও সেখানে মিলেছে অবৈধ আরেকটি পিস্তল। তবে ওই পিস্তলটি খুনের ঘটনায় ব্যবহার করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন পটিয়া থানা পুলিশ।
পটিয়া থানার ওসি (তদন্ত) রাশেদুল ইসরাম জানান, জেলা জাপার কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর সময় একটি পিস্তল খুঁজে পান। তবে খুনের ঘটনায় ওই পিস্তলটি ব্যবহার করা হয়নি। খুনের ঘটনায় ব্যবহার করা হয়েছে অন্য একটি পিস্তল। সে পিস্তলের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, শামসু মাস্টারের লাইসেন্স করা শর্টগানটি এখনো পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে ওই অন্ত্রটি মাইনুল অন্য কোথাও রেখেছে। ওই অস্ত্র এবং খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। মাইনুলকে গ্রেপ্তার করা গেলে দুুটি অস্ত্রের সন্ধান মিলবে।