চেতনার জাগরণে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠের নাম

20

 

 

পাকিস্তানি তমসা মোচন করে বাঙালি জাতির যে জাগরণ সূচিত হয় বায়ান্নর একুশে ফেব্রæয়ারি তা সর্বজনের অন্তরে সর্বকালের জন্য ঠাঁই করে নেয়। সেই সময়ের দুই তরুণ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রচনা ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের কথা ও সুরের সম্মিলনে সৃজিত হয় অমর গান “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি ”। সেই থেকে বাঙালির জাতীয় চেতনার বিকাশের প্রতিটি সংগ্রাম ও তার বিভিন্ন উত্থানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম।
১২ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়া গ্রামের চৌধুরী পরিবারে অসংখ্য প্রতিভাবান তারকার মাঝে, ব্রিটিশ আমলে বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সভাপতি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কারাবরণকারি জমিদার হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী ও জোহরা খাতুনের দুই ছেলে, চার মেয়ের মধ্যে অন্যতম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, সম্পাদক, নাট্যকার, গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, রাজনীতি বিশ্লেষকসহ বহু অভিধায় ভূষিত। তিনি স্বকীয় উজ্জ্বলতায় ভাস্মর অনন্য গুণি মানুষ। সাহিত্যিক ও কলামিস্ট হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত এই মহান লেখকের জীবন ইতিহাস বৈচিত্র্যময় ও সংগ্রামমুখর। যখন তিনি ক্লাস ফোরে পড়েন তখন কবিতা লেখার মাধ্যমে লেখালেখির সূচনা। তারপর তাঁর কলম উপহার দিয়েছে বাঙালির জন্য অগণিত কালজয়ী রচনা। তাঁর প্রখ্যাত কবিতা সংগ্রহ “সময়ের ঘড়ি”। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন গ্রামবাংলার চিত্র নিয়ে তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম“স্বাক্ষর”। এটি ১৯৪৯ সালে মাসিক সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র নিয়মিত গল্প-লেখক। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কৃষ্ণপক্ষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। তারপর সম্রাটের ছবি, সুন্দর হে সুন্দরসহ জীবন ঘনিষ্ঠ কিছু গল্পগ্রন্থ লেখক আমাদের উপহার দেন; যা বাংলা সাহিত্যধারাকে করেছে সমৃদ্ধ, জুগিয়েছে আমাদের জীবনপথের পাথেয়।
বরিশাল থাকাকালে স্কুলজীবনেই মার্কসবাদী সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদী প্রগতিশীল রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর। যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের মিছিলে। প্রয়াত রাজনীতিবিদ-অর্থনীতিবিদ স্বদেশ বসূর আহŸানে পটুয়াখালীতে কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রথম দেখেন প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদকে। এছাড়া বরিশালে তিনি বামপন্থি রাজনৈতিক দল আর.এস.পির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আতœজীবনীতে তিনি লিখেছেন-তাঁর বংশীয় পূর্বপুরুষ চৌধুরী মোহম্মদ আরিফের প্রভাবে তিনি কৈশোরেই অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনায় দীক্ষা লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ছাত্রলীগে যোগদান করেন। তিনি এবং প্রয়াত কথাশিল্পী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম-আহŸায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলন, বাংলা হরফ রক্ষায় আন্দোলন, রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষে আন্দোলন, যুক্তনির্বাচন প্রথা প্রবর্তনের আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন আইয়ুব শাহির প্রেস অ্যাক্টবিরোধী আন্দোলন এবং ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ছাত্রজীবনেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে কবিতা লেখা শুরু, তারপর গল্প। স্কুলজীবনে ১৯৪৯ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত কলকাতার মাসিক সওগাত পত্রিকায় “স্বাক্ষর” নামে তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়। এর বিষয়বস্তু ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন গ্রামবাংলা চিত্র। শিশু সওগাত-এ প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ ‘যুগধর্ম’। স্কুলের ছাত্র গাফ্ফার চৌধুরী সাহিত্যিক বিমল ঘোষ ওরফে মৌমাছির নেতৃত্বে সারা অবিভক্ত বাংলায় গড়ে ওঠা কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকায় শিশু সংগঠন মণিমেলার সদস্য ছিলেন। একই সঙ্গে মণিমেলার আদলে মোহাম্মদ মোদাব্বের ওরফে বাগবানের নেতৃত্বে গড়ে উঠা ঢাকার আজাদ পত্রিকার মুকুলের মহফিলের ও সদস্য ছিলেন। ১৯৪৫-এ কোলকাতা নবযুগ পত্রিকার আগুনের ফুলকি বিভাগে ‘পান্থশালা’ নামে নাটিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬-৪৭ কালপর্বে মুকুলের মহফিলের পাতায় তাঁর “আষাঢ়ে” নামে কবিতা ও “বার্নার্ড” শ’র কলম’ নামে গল্প প্রকাশিত হয়। সেসম্য় তাঁর গল্প নাটিকা প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার সুবিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা সোনার বাংলায়।
ভাষা আন্দোলন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বেই তিনি বরিশাল এ.কে.হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তাতে যোগ দিয়ে বরিশালে জেল খেটেছেন। ৪৮-এর ১১ মার্চের ভাষা দিবসের আগেই হাজতবাস হয়েছিল তাঁর। ফলে পুনরায় গ্রেফতারের আশংকায় তিনি বরিশাল থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বেও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। ১৯৫৫ সালে ভাষাশহিদ দিবস পালন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কারাবন্দি হয়ে একমাস ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি ছিলেন। ১৯৫২-র ফেব্রæয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল কালপর্বে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙার সময়খন্ডে পুলিশের লাঠির আঘাতে তিনি অজ্ঞান হয়ে কার্জন হলে পড়ে ছিলেন। জ্ঞান ফিরলে দেখেন ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার পায়ে বরফ ঘষে শুশ্রুষা করছেন। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগদান সম্পর্কে গাফ্ফার চৌধুরীর নিজের –“১৯৫২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র এবং “দৈনিক সংবাদ”-এর নিউজ ডেস্কে রাত্রে কাজ করি। সংবাদ থেকে পাওয়া মাসে একশ’ টাকা বেতনই ছিল আমার নিজের ও লেখাপড়ার খরচ চালাবার প্রধান সম্বল। ‘সংবাদ’ নূরুল আমিনের কাগজ জেনেও আমি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেই এবং ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের লাঠিচার্চে আহত হয়ে কিছুদিন এখানে থাকার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে বাধ্য হই। কারণ, পায়ের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠেছিলো। গোড়ালী ফুলে উঠেছিলো। হাঁটতে পারতাম না। একমাস ছিলাম হাসপাতালে।” (সূত্র: ধীরে বহে বুড়িগঙা) ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ রচনার ইতিহাস তিনি বর্ণনা করেন এভাবে “১৯৫২ সাল। একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে হাসপাতালে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের বারান্দায় শহীদ বরকতের রক্তমাখা লাশ দেখে এই গানের প্রথম দুটি লাইন আমার মনে জেগে ওঠে। পুরো গানটি লিখেছি দু’ একদিন পরে ধীরে ধীরে ।” (সূত্র: ধীরে বহে বুড়িগঙা)
তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারগুলো হলো- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (ছোটগল্প, ১৯৬৭), ইউনেস্কো (সাহিত্যকর্মের জন্য), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, শেরে বাংলা পুরস্কার, মানিক মিয়া স্বর্ণপদক ২০০৯, একুশে পদক (সাহিত্য) ১৯৭৭, স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৯, ৭৫ বছর পূর্তিতে লন্ডনভিত্তিক প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন সংহতি কর্তৃক জাতীয় জাদুঘরে সংবর্ধনা প্রদান, বাংলা একাডেমি কর্র্তৃক ভাষাসংগ্রামী সংবর্ধনা ২০১১, লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল থেকে ফ্রিডম অব সিটি পদক লাভ, পিআইবি সোহেল সামাদ স্মৃতি পুরস্কার ২০১৪।
বরিশালে স্কুলছাত্র থাকাকালেই বরিশাল হিতৈষী পত্রিকার সম্পাদক দুর্গামোহন সেনের কাছে তাঁর রিপোটিং লেখা শেখা। এই পত্রিকায় তিনি ‘সমাচার সন্দেশ’ নামে ফিচার লিখতেন। সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় রচনায় সহায়তা পেয়েছেন সাপ্তাহিক নকীব পত্রিকার নূর আহমদের কাছ থেকে।
১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজের ভর্তি হয়ে তাঁর জীবনের ঢাকাপর্ব সাংবাদিকতা শুরু করেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। ১৯৫১-তে যোগ দেন খায়রুল কবীর সম্পাদিত দৈনিক সংবাদ পত্রিকার বার্তা-বিভাগে। এরপর বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সম্পাদিত সওগাত ও বেগম পত্রিকায়। সাংবাদিকতা করেছেন দৈনিক মিল্লাত এবং দৈনিক পূর্বদেশের সমম্পাদকীয় বিভাগেও। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে। ইত্তেফাকে তাঁর প্রথম কলামের বিষয় ছিল-‘পূব পাকিস্তানের খাদ্যপরিস্থিতি।’ ষাটের দশকে যুক্ত হন আজাদ পত্রিকার সঙ্গে। তৃতীয় মত নামের বিখ্যাত কলাম লেখার পাশাপাশি আজাদ পত্রিকায় নানা পেশার মানুষদের নিয়ে ফিচারও রচনা করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনকালে তিনি নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন সান্ধ্য কাগজ আওয়াজ। ১৯৫৮ সালে প্যারামাউন্ট প্রেসের সত্ত¡াধিকারী হাবিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত সচিত্র মেঘনা সাহিত্য-মাসিকের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। উল্লেখ্য এ পত্রিকা প্রকাশে শুভেচ্ছা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শুভেচ্ছাবাণী প্রদান করেছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকা (ভোয়া) তে ফিচার প্রদানের পাশাপাশি বেতার-টিভিনাটক ও নানা অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্টও রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রকাশিত দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত নতুন দিন-এরও সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছদ্ম নামে ও পরে নিজ নামে অসংখ্য রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন যা রাজনৈতিক কলামকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে এখনো অবিরত লিখে চলেছেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ।
১৯৪৭ থেকে শুরু করে আজ অবধি বাঙালির চেতনা বিকাশের আন্দোলন, সংগ্রামে, সংকটে নিবেদিত এই আলোকিত মানুষটি জাতিকে চেতনার আলোর প্রদীপ হাতে তুলে দিয়ে অচিন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁর এ মহাপ্রয়ানে গভীরভাবে শোকাহত। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁকে ওপারে ভালো রাখুন-এ প্রার্থনাই থাকল।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও শিশুসাহিত্যিক