চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে নানা মত পাহাড়ে ফিরেনি শান্তি

35

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের শেষ হয়নি। এত বছর পরও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে নানান মত। সরকার পক্ষ বলছে-চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলোও বাস্তবায়িত হবে। অন্যদিকে জেএসএসের অভিযোগ-সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে লঙ্ঘন করছে।
পাহাড়ের তিন সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড়। আর শান্তিচুক্তি সংশোধনের দাবিতে বাঙালি সংগঠগুলো আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। চুক্তির পর থেকেই পাহাড়ি সংগঠনগুলোর পারস্পরিক সংঘাত লেগেই আছে। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনও করেছিলেন। বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি-এই তিন পার্বত্য জেলার দীর্ঘ দিনের পাহাড়ি-বাঙালিদের দ্ব›দ্ব-সংঘাত বন্ধ করে পার্বত্যঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ের স্বশস্ত্র বাহিনী (শান্তি বাহিনী) সাথে শান্তি চুক্তি করে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার। কিন্তুু শান্তি চুক্তির ২৩টি বছর পরেও পাহাড়ে পরিপূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর পাল্টাপাল্টিতে আর সংঘাতে আজও উত্তাল পাহাড়ি জনপথ। এ নিয়ে একে-অপরকে দুষছেন পার্বত্য অঞ্চলের নেতারা। তবে দ্রুত চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলে মনে করেন পাহাড়ি নেতারা। ১৯৯৭ সালের এই দিনে বর্তমান সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই হয়।
এদিকে জেএসএস নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও এখনো পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরে আসেনি। বরং চুক্তির পর পাহাড়িদের জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ- তিনটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। পার্বত্য চুক্তি প্রশ্নে তাদের অবস্থানের ভিন্নতা রয়েছে। এ ভিন্নতার কারণে পাহাড়িদের মধ্যে ঘটছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। পাহাড়ে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নেতাদের রয়েছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। অপরদিকে সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে- ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রায় ৯০ ভাগ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। কয়েকটি ধারা বাস্তবায়নে উভয় পক্ষে এক সাথে বসে সমাধান করার কথাও বলা হচ্ছে। চুক্তির শর্ত ধারা মতে, শান্তিবাহিনীর সকল সদস্যকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হয়েছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না এমন অভিযোগ ভিত্তিহিন মনে করেন সরকারি দলের নেতারা।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা ছোটন কান্তিÍ তঞ্চঙ্গ্যার মতে, যে শান্তিচুক্তি হয়েছে সরকার এবং জেএসএস এর মধ্যে তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হবে বা জনগণ মুক্তি পাবে। জনগণ উপকৃত হবে তা আমরা মনে করি না। যার কারণে আমরা শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে আসছি। বর্তমানে পার্বত্য এলাকার যে পরিস্থিতি হানাহানি খুনোখুনি হচ্ছে এবং ভূমির উপর নানা আগ্রাসন হচ্ছে এগুলো শান্তি চুক্তির কোনো সুফল নয়।
মানবাধিকার নেত্রী ডনাই প্রূ নেলী বলেন, শান্তি চুক্তি হয়েছে শুধু পাহাড়িদের জন্য। পাহাড়ের বসবাসরত সব মানুষের জন্য। পাহাড়ে শান্তি চুক্তির পর অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে আমরা যেভাবে আশা করেছিলাম, উন্নয়নের পাশাপাশি পাহাড়ের মানুষরা শান্তিতে বসবাস করবো, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবো,সেই জায়গাটা এখনো আতংক রয়ে গেছে। শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে, এখানকার প্রতিটি সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন এই নেত্রী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, তেইশ বছরও শান্তিচুক্তির কোনো সুফল পাহাড়ের মানুষ পায়নি। অধিকাংশ শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেখানে সেনা ক্যাম্পগুলো তুলে নেওয়ার কারণে পাহাড়ে এখনো হানাহানি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়ে গেছে। তবে পাহাড়ে শান্তিশৃংখলা রক্ষার জন্য অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প পূণরায় স্থাপন করা হলে হানাহানি বন্ধ হবে বলে মনে করেন এই নেতা। তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির পর জেএসএস তাদের স্বার্থ উদ্ধারের পর পাহাড়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব শূণ্য করার জন্য বেছে বেছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরকে গুম খুন হত্যা করা হচ্ছে।
জেএসএস এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক কে এস মং বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সন্তু লারমার মধ্যে একটি বৈঠক করতে হবে, ঐ বৈঠকের মাধ্যমে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হবে, নাকি হবে না, তা পার্বত্যবাসী ও সারা বাংলাদেশের মানুষকে একটা মেসেজ দিতে হবে। তবে মেসেজ যদি দেয়া না হয় পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি আরোও জটিল হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা ও বিশ^াস আছে শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে তিনি এগিয়ে আসবেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বান্দরবান সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, শান্তিচুক্তির ফলে শিক্ষাসহ জীবনমান যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে অতীতে কোনোকালেই পাহাড়ের সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে নাই। এবং শান্তিচুক্তির ৯০ ভাগ শর্ত ইতোমধ্যে সরকার বাস্তবায়ন করেছে। তবে বাকি কয়েকটি ধারা বাস্তবায়নে উভয় পক্ষকে এক সাথে বসে সমাধান করার জন্য বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু এটাকে জিইয়ে রেখে স্বার্থহাসিলের জন্য জেএসএস নিজের দোষ এখন সরকারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।