চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর চীনকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে হবে

15

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশের কক্সবাজারে অশ্রয় নেয়। এর আগে প্রায় ৩০ বছর যাবৎ পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। তবে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ আশ্রিত সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। আগে পরে সব মিলিয়ে এখন প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা দেশের প্রধান পর্যটন জেলা কক্সবাজারের উখিয়া, রামু ও টেকনাফ উপজেলায় রয়েছে। জনবহুল অথচ ছোট্ট একটি দেশে এত ব্যাপক সংখ্যক লোকের আশ্রয় এবং তাদের খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসার যোগান দেয়া অসম্ভব ব্যাপারে। এরপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক অবস্থান থেকে মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীর জাতি বিধ্বংসি গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে রোহিক্সগা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সীমানা খুলে দেয়া হয়। এটি ছিল একান্তই সাময়িক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এসময় শেখ হাসিনার এ সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরৎ পাঠাতে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টিসহ বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বিগত পাঁচ বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান বা তাদের ফেরৎ নেয়ার ক্ষেত্রে কোন কার্যকর প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘ সময় চলমান থাকলে বাস্তুচ্যুত এই জনগোষ্ঠীর কট্টরপন্থা, সন্ত্রাস এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে এবং এর ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও বৃহত্তর এ অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। উদ্ভুত এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এবংআঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ২০২১ সালের ১ ফেব্রæয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত। সামরিক সরকার এখন চীনের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এ কারণে চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে রোহিঙ্গাদের দ্রæত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারে। চীনের এই পদক্ষেপ রাখাইনে স্থিতিশীলতা এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। আমরা আশান্বিত হয়েছি যে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরপর এবছর ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিতভার্চুয়াল বৈঠকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি চীনের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুও ঝাওহুই উপস্থিত ছিলেন এবং আলোচনা শেষে প্রত্যাবাসন শুরু করতে সব পক্ষ সম্মত হয়। চীনের এধরণের আন্তরিক উদ্যোগ সংকটকে সমাধানের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। মিয়ানমারের উপর চীনের প্রভাব থাকায় চীন এ সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চলতি মাসের এর ছয়মাস পর ৬ আগস্ট চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়াও চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে আরও ১ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্য ও সেবার শুল্কমুক্ত সুবিধার ঘোষণা দেওয়া হয় চীনের তরফ থেকে।এর ফলে বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ পণ্য ও সেবা বিনাশুল্কে চীনে প্রবেশাধিকারের সুযোগ পাবে। এটিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসাবে দেখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে। তবে তিনি বলেছেন, তৃতীয়পক্ষের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হলে চীন তার ভূমিকা পালন করবে। বস্তুত এক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা আরও সুস্পষ্ট ও স¤প্রসারিত হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। রোহিঙ্গাদের দ্রæত প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে কাজ করার ব্যাপারে চীন আগেও একাধিকবার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিফলন আমরা লক্ষ করিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী। সেক্ষেত্রে চীন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে, আমরা এটাই চাই।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং বিস্তৃত। রোহিঙ্গা ইস্যু এই সফরে বাংলাদেশের টপ প্রায়োরিটিতে থাকা এজেন্ডা। এই সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ এই সফরে রোহিঙ্গা সংকটে চীনের আরও জোরালো ভূমিকা থাকবে এমনটি প্রত্যাশা বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।