চীনবিরোধী নতুন জোটের ডাকে কতটা সাড়া দেবে ইউরোপ

7

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা জানিয়েছেন জি-সেভেন বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ শনিবার আলাপ-আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল চীন এবং বিশ্বে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলার উপায়।
হোয়াইট হাউজের একজন কর্মকর্তা বলেন, অবকাঠামো এবং অন্যান্য কারিগরি সাহায্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে চীন যেভাবে তাদের প্রভাব বলয় বাড়াচ্ছে তার মোকাবেলায় বিকল্প অভিন্ন একটি কৌশল নিতে নতুন একটি পশ্চিমা জোট তৈরির প্রস্তাব দেবেন মি. বাইডেন।
গত তিন দশকে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বিশ্বের একশটিরও বেশি দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে – যা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা, উদ্বিগ্ন। তাদের ভয়, গত কয়েকশ বছর ধরে উন্নয়নশীল বিশ্বে তাদের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে তা হুমকিতে পড়েছে।
বিবিসির উত্তর আমেরিকা বিষয়ক সম্পাদক জন সোপেল বলছেন, আমেরিকার বর্তমান সরকার তার মিত্রদের বলতে চাইছে যে, ‘পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্ব‘ বাকি বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। বাকি বিশ্বকে বলতে হবে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে আখেরে তাদের বিপদে পড়তে হবে, চীন মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেনা,সুস্থ প্রতিযোগিতার ধার ধারেনা। জন সোপেল বলছেন, আমেরিকান কর্মকর্তারা বলতে চাইছেন যে এটা চীনের সাথে টক্কর দেওয়ার কোনো বিষয় নয়, বরঞ্চ চীনের একটি ‘ইতিবাচক বিকল্প’ বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। কিন্তু বিশ্বের অবকাঠামোর প্রয়োজন মেটাতে পশ্চিমা দেশগুলো কতদিনে কত অর্থ বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত – তা নিয়ে হোয়াইট হাউজ এখনও অস্পষ্ট। তবে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে আমেরিকা মনে করে চীনের প্রভাব মোকাবেলায় পশ্চিমা বিশ্বকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, চীনকে আটকাতে আমেরিকার সাথে জোট বাঁধতে এখন কতটা উৎসাহী হবে ইউরোপ? সাম্প্রতিক সময়ে, শিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিম ইস্যুতে আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে চীনের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। উইঘুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজন চীনা কর্মকর্তার ওপর ভ্রমণ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার বর্তমান যে চিত্র তাতে চীনের সাথে খোলাখুলি বড় কোনো বিবাদে জড়িয়ে যাওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হবে বলে অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী দেশ। ইইউ এবং চীনের মধ্যে গত বছর বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। চীনে ইইউ জোটের দেশগুলোর রপ্তানি ছিল ২০ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
ইউরোপের শিল্পোন্নত কয়েকটি দেশের সাথে, বিশেষ করে জার্মানি এবং ইটালির সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বছরে বছরে বাড়ছে। জার্মানির বড় বড় অনেক শিল্পের প্রধান বাজার এখন চীন।
এ কারণে, গত সাত বছর ধরে দেন-দরবারের পর চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে কয়েক মাস আগে দীর্ঘমেয়াদী একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে, যদিও উইঘুর ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা পাল্টা-নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ঐ চুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন স্থগিত হয়ে রয়েছে।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, যদিও চীনের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক এখন ততটা ‘স্থিতিশীল‘ নয়, কিন্তু গত ১০ বছর ধরে চীন আলাদা আলাদাভাবে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে।
চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তদের বিআরআই-এর আওতায় ইতালি, গ্রিস, হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়ায় অনেক বিনিয়োগ করেছে। ফলে, চীনের ইস্যুতে ইউরোপে ঐক্যবদ্ধ কোনো অবস্থান এখন আর নেই। একেক দেশের দৃষ্টিভঙ্গি এককে-রকম।
ড. আলী বলেন, আমেরিকা চীনকে যতটা হুমকি হিসাবে দেখছে, যতটা প্রতিদ্ব›দ্বী ভাবছে, ইউরোপের অনেক দেশ সেভাবে দেখছে না, ভাবছে না। চীনকে দেখে নিতে আমেরিকার যতটা একরোখা, ইউরোপের বহু দেশই তা নয়। গত কয়েক বছর ধরে চীনকে নিয়ে আমেরিকায় রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক যেসব সরকারি নথিপত্র তৈরি হয়েছে তাতে পরিষ্কার যে তারা চীনের সাথে সম্ভাব্য একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু ইউরোপ এখনও সেভাবে ভাবছে না। তবে উইঘুর ইস্যুতে আমেরিকার সাথে তাল মেলানোর পাশাপাশি, সম্প্রতি ব্রিটেন এবং ফ্রান্স দক্ষিণ চীন সাগরের প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীনের সাথে চলমান রেষারেষিতে আমেরিকার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে ঐ অঞ্চলে মহড়ার জন্য যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। তারপরও চীন বিশ্বাস করে আমেরিকা এখন তাদের যে চোখে দেখে, ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি ততটা কট্টর নয়। চীনের ব্যাপারে তাদের উৎকণ্ঠা রয়েছে, কিন্তু আমেরিকার মত তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি এখনও নেই।
কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে নূতন একটি পশ্চিমা জোট তৈরির জন্য আমেরিকার এই পদক্ষেপ চীন কতটা চিন্তিত? ড. আলী বলেন, গত প্রায় ৫০ বছর ধরে চীনের নীতি খুব স্পষ্ট – তারা নিজেরা কখনো আগ বাড়িয়ে মারমুখী হবেনা, কিন্তু তারা আক্রান্ত হলে প্রতি-আক্রমণ করবে। চাপের কাছে তারা নতজানু হবেনা। এ ব্যাপারে চীনকে এখন আপোষহীন বলেই মনে হয়, এবং তাদের এই অবস্থান তারা আমেরিকাকে জানিয়ে দিয়েছে।
পশ্চিমাদের ব্যাপারে চীনের এই মনোভাবের পেছনে রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের রক্তাক্ত ইতিহাস। দেড়শ বছর ধরে পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে চীন নতজানু হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের থাকার সময় চীন ভাগ হয়ে গেছে। চীনা সৈন্যদের হটিয়ে পশ্চিমারা চীনের বিভিন্ন জায়গায় তাদের সেনা-ঘাঁটি তৈরি করেছে। এমনকি একশ বছর ধরে চীনের ইয়াংসি নদীর নিয়ন্ত্রণ ছিল চারটি পশ্চিমা শক্তির নৌ বাহিনীর কব্জায়। এসব স্মৃতি জাতি হিসাবে চীনাদের মনে গেড়ে বসে রয়েছে। তাদের কথা, আর কখনই তারা পশ্চিমাদের ভ্রুকুটি দেখতে রাজী নয়, বলেন ড আলী।
এ কারণে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে বৃহস্পতিবার এই প্রথম চীনে ‘নিষেধাজ্ঞা বিরোধী‘ একটি আইন পাশ হয়েছে। এর ফলে, এখন থেকে চীনা কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বৈষম্যমুলক আচরণ করলে জড়িতদের ওপর পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেয়া যাবে। সেই সব ব্যক্তি বা কোম্পানিকে চীন থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে, চীনের সাথে তাদের ব্যবসা নিষিদ্ধ হতে পারে, চীনে তাদের সম্পদ কুক্ষিগত করা যেতে পারে।
চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমারা এতদিন প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে যে পথ নিয়েছে, চীন ঠিক সেই পথই নিচ্ছে। হংকংয়ের সিটি ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ওয়াং জিয়াং উ বার্তা সংস্থা রয়টর্সকে বলেছেন, আইনি পথে এই ধরনের পাল্টা নিষেধাজ্ঞার পথে যাওয়ার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শক্তি চীনের আগে ছিলনা, এখন তাদের সেই ক্ষমতা হয়েছে।
এছাড়া, ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, চীনা ঋণের জালে আটকে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে যে প্রচারণা আমেরিকা শুরু করেছে তাতে তেমন কাজ হবে বলে চীন মনে করেনা। এটা ঠিক চীন যে একশরও বেশি দেশে বিনিয়োগ করেছে তাদের সবাই সমানভাবে লাভবান হয়নি, কিন্তু এটিও সত্যি যে ঐসব দেশ তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে প্রধানত বিশ্বব্যাংকের সূত্রে যেসব পশ্চিমা বিনিয়োগ হয়েছে তার সাথে বহু শর্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে যা নিয়ে পরে তারা বিপাকে পড়েছে। তারা দেখছে চীন অন্তত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলায় না।