চিলেকোঠা

39

জুয়েল আশরাফ

রায়িসা চিলেকোঠায় চায়ে চুমুক দিয়ে তার প্রিয় সাহিত্য পত্রিকা পড়তে পছন্দ করে। সময় পেলেই বই নিয়ে চিলেকোঠায় বসে পড়ে। এটা তার প্রিয় জায়গা। এখানে সে দারুণ স্বাচ্ছন্দ বোধ পায়। বাড়ির পাশের কদম গাছ ফাল্গুন মাসে শীতল ছায়া দিচ্ছে। রায়িসা এ বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে। যৌবনের দ্বারপ্রান্তে পা রেখেছে। পরীক্ষার পরে সে উপন্যাস পড়ে সময় কাটায়।
রায়িসাদের বাড়ির সামনে থাকেন তালুকদার পরিবার। বাড়ির ছেলেমেয়েরা প্রায়ই ছাদে খেলে, মাঝে মাঝে রায়িসা চিলেকোঠা থেকে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলে।
একদিন রায়িসা দেখল সামনের বাড়ির একটা ছেলে তাকে দেখছে। রায়িসার চোখ তার উপর পড়লে সে চোখ গুটিয়ে নেয়। ওই ছেলেটিকে সে সেখানে আগে দেখেনি। তালুকদারের মাত্র দুইটি ছেলেমেয়ে আছে বাইরে খেলছে, তাহলে এই ছেলে কে হবে? মনে মনে ভাবল। একদিন সে বাইরে খেলতে থাকা বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করল তাদের বাড়ির ওই ছেলেটি কে?
একটি শিশু জানাল, সে তাদের বড় চাচার ছেলে, শীতের ছুটি কাটাতে এসেছে।
রায়িসা দুই-তিন দিন খেয়াল করে যখনই সে চিলেকোঠায় আসে ছেলেটি সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। রায়িসা এখন চিলেকোঠায় আসতে একটু ইতস্তত করছে, কিন্তু বাড়িতে তার ভালো লাগছে না, সকাল সন্ধ্যা তার প্রিয় জায়গায় সময় কাটানোর অভ্যাস। যদি সে আমাকে দেখে, এসবে আমি মাথা ঘামাচ্ছি কেন, আমি কেন তার ক্ষেত্রে আমার স্বাধীনতা ছেড়ে দেব- ভাবতে ভাবতে রায়িসা চিলেকোঠায় বসতে শুরু করল। কিন্তু রায়িসা কোনো না কোনো অজুহাতে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল। বোধহয় কোথাও না কোথাও সেও ছেলেটিকে দেখতে পছন্দ করতে শুরু করেছে। প্রেম অনুভূতি ও আবেগের এক অনন্য মিলন, সবাই ডুব দিতে চায় আর এখন রায়িসা কেবল যৌবনের দোরগোড়ায় পা রেখেছে, এই বয়সটি নরম, সূ², এই বয়সে আকর্ষণ স্বাভাবিক।
একদিন তালুকদারের ছোট ছেলে রায়িসার কাছে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ বইটি থাকলে দাও।
রায়িসার একটু অদ্ভুত লাগল। তার প্রিয় একটি বই। মোট সাতবার পড়েছে। ছেলেটি এই বাচ্চাটিকে দিয়ে পাঠিয়েছে বইটা খুঁজতে। যাক, ভালোই হলো, নইলে অযথা ভাবছিল সে। রায়িসা বইটি এনে শিশুটিকে দিল। এরপর দুই দিন ছেলেটিকে বারান্দায় দেখতে পেল না। দুদিন পর বাচ্চাটা আবার এসে বইটি ফেরত দিয়ে আরেকটা বই দিতে বলল। তারপর বলল, ভাই বলেছে ধন্যবাদ।
এবার রায়িসা শিশুটিকে আরেকটি বই দিল। শিশুটি দুদিন পর বইটি ফেরত দিয়ে তারপর আরেকটি বই চাইল। এবার রায়িসাও একটু বিরক্ত হল। ‘আমি কী তার কাছে এমন কোনো লাইব্রেরি, যখন খুশি বই চাইবেন আর আমি দেব? সে এত পড়ার শৌখিন, তাহলে কেন বই কিনে পড়ে না?’ মনে মনে বিড়বিড় করে তারপর সেই শিশুটিকে একটা বই দিল। যতবার শিশু বই নিতে আসে, ছেলেটি তার জানালা বা বারান্দা থেকে এমনভাবে দেখে যেন সে নিজেই এখানে প্রতিনিধি হয়ে ছোট শিশুকে বই নিতে পাঠিয়েছে। শিশুটি পরের দিন বইটি ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেল, এবার সে কিছু বলল না। রায়িসা চিলেকোঠায় গিয়ে দেখল ছেলেটি বারান্দায় নেই। ভেতরে এসে বইটা খুলতেই একটা কাগজ পড়ে গেল।
রায়িসা আগ্রহ নিয়ে কাগজটা খুলল, তাতে লেখা- ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ সঙ্গে সঙ্গে রায়িসার হৃদস্পন্দন জোরে জোরে চলতে শুরু করে, এর আগে কেউ তাকে প্রস্তাব দেয়নি। হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে, তার মনে হয়, এই কাগজটা যদি বাড়ির কারো হাতে পড়ে, তখনই সে কাগজটা ছিন্নভিন্ন করে ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।
রায়িসার মনে এলো যে পুরানো বইগুলো সে ফেরত দিয়েছিল, তাতে তো কিছু লিখেনি? সে সঙ্গে সঙ্গে পুরানো বই দুইটি খুলে ফেলল, যার প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় একটাতে লেখা ছিল ‘আই লাভ ইউ রায়িসা’। কেমন করে সে তার নাম জানে? এখন পর্যন্ত ওই ছেলেটির নাম জানা যায়নি, ভয়ে আতঙ্কে সে বইটাও ছিঁড়ে ফেলল।
আজ সন্ধ্যায় রায়িসা চিলেকোঠায় যায়নি, বাইরে গিয়ে ছেলেটির সঙ্গে চোখের যোগাযোগ করার সাহস তার নেই। কিন্তু হার্টবিট এখন কমে গেছে। রায়িসার মনেও প্রেমের আলোড়ন। নার্ভাসনেসের কারণে সে কাগজটাও ঠিকমতো পড়েনি। ‘আমি কতটা বোকা, আমি সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেললাম, যদি আমি ঠিকভাবে পড়তাম, তাহলে আমার রুমের কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারতাম। প্রথমবারের মতো কেউ আমাকে বলেছে- আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি সেই মুহূর্তটি ভালোভাবে কাটাতে পারিনি।’ মনে মনে এসব রায়িসা ভাবতে লাগল।
এবার তার মনে হল সেই কাগজটা আরেকবার পড়বে। ঘরের পেছনের দরজা খুলে সে পেপারটা পেল যেটা পেছনে বাগানের গাছে আটকে আছে, কিছু টুকরো কাছেই ছড়িয়ে আছে, সেগুলো জড়ো করে ঘরে নিয়ে এসে কাগজটা ভাজ করে টেপের সঙ্গে আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে পড়তে লাগল- যেদিন তোমাকে প্রথমবার দেখেছি, তোমাকে চিলেকোঠায় বসে দেখেছিলাম, তখন থেকে তুমি আমার হৃদয়ে স্থির হয়ে গেছো। তোমাকে প্রতিদিন দেখে, হাসিমুখে, শিশুদের সঙ্গে কথা বলে, মনকে অনেক শান্তি দিতাম।
আমার অল্প সময়। যাওয়ার আগে আমি তোমাকে আমার মনের কথা বলতে চাই। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি রায়িসা। তুমিও যদি আমার ভালোবাসা মেনে নাও তাহলে সন্ধ্যাবেলা চিলেকোঠায় হাসিমুখে এসো। আমি তোমাকে আমার নম্বর দেব। আমি ইশারায় বলব, ভালো না লাগলে এই কাগজটা দেখিয়ে আমার সামনে ছিঁড়ে দিও।
পুরো চিঠিটা পড়তেই রায়িসা দৌড়ে বারান্দার দিকে গেল। কিন্তু বোধহয় অনেক দেরি হয়ে গেছে, সামনের ঘরে অন্ধকার। অনেক দিন ধরে রায়িসা সেই ঘরের দিকে বারবার অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। একদিন সাহস করে সেই ছোট্ট শিশুটিকে জিজ্ঞেস করল। শিশুটি জানাল, ভাইয়ের ছুটি শেষ, তাই তিনি তার বাড়িতে ফিরে যান।
বছর ঘুরতেই রায়িসার বিয়ে হয়ে গেল। অনেক বছর হয়ে গেল, কিন্তু আজও সে সেই ছেলেটিকে ভুলতে পারেনি। যখনই সে তার মাতৃগৃহে আসে, সে অবশ্যই চিলেকোঠায় এসে একবার সেই বাড়ির দিকে তাকায়।