চিকিৎসকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি

70

ধারাবাহিক তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের ইশতেহারে ঘোষিত অঙ্গীকারগুলোর অন্যতম হচ্ছে জনগণের দোরগোড়ায় উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। নবাগত স্বাস্থ্যমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর স্বাস্থ্যসেবায় পূর্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সমগ্র জনগোষ্ঠীর কাছে এ সেবা পৌঁছিয়ে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। তিনি চিকিৎসকদের দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেন। কিন্তু চিকিৎসকদের কাছে নতুন মন্ত্রীর এসব কথা খুব বেশি কর্ণগোছর হয়েছে বলে মনে হয় না। তারা ঠিক আগের মতই পদায়নস্থল ত্যাগ করে শহরের প্রাইভেট চেম্বারের প্রতি আগ্রহী বলে প্রতিয়মান হয়। অথচ দেশের বেশির ভাগ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে, তাই সরকার গ্রামাঞ্চলের অধিক মানুষকে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে ইউনিয়ন পর্যায়ে চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলেছে। চিকিৎসকও নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা সেখানে যান না বললেই চলে। এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও অর্ধেকের বেশি চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন। বাকিদেরও অনেকে হাসপাতালে এসে সই করেই চলে যান। সরকারের বিনামূল্যে বিতরণের ওষুধ রোগীরা পায় না। হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্স, রোগনির্ণয় যন্ত্র বা চিকিৎসা সরঞ্জাম অকেজো হয়ে থাকে। ইচ্ছাকৃতভাবে অকেজো করে রাখার অভিযোগও কম নয়। হাসপাতালে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি স্থাপন করা হয়, কয়েক দিনের মধ্যেই তা নষ্ট হয়ে যায় বা নষ্ট করে দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে যাঁরা সেবা দেবেন, তাঁদের মানসিকতা যদি এমন হয়, তাহলে সরকারের সদিচ্ছার বাস্তবায়ন হবে কিভাবে ?
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, তাতে জনমতেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে আমরা মনে করি। তিনি যথার্থই বলেছেন- সেবা দিতে অনীহা থাকলে সরকারি চাকরি করার দরকার কী? আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর এমন কঠোর বার্তা ও নির্দেশনার পর সংশ্লিষ্টদের টনক নড়বে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এবারই প্রথম এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন- এমনও নয়। আমাদের মনে আছে, সর্বশেষ গত অক্টোবরেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবস্থান করে সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেও তিনি এবারের মতোই বলেছিলেন উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে না চাইলে চাকরি ছেড়ে দিতে। আমরাও সম্পাদকীয় কলামে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর তাগিদের প্রতিধ্বনি করেছি। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। বরং গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থানরত শতাধিক চিকিৎসককে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশ ঠেকাতে প্রকাশ্যেই শুরু হয়েছিল বিভিন্ন মহলে ‘তদবির’। আর চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে দেখা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশের আট জেলার ১১টি হাসপাতালে গড়ে ৪০ শতাংশ চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত। এই চিত্র কেবল হতাশার নয়, ক্ষোভেরও। আমরা বহুল উচ্চারিত সেই আপ্তবাক্যের পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, চিকিৎসকের অনুপস্থিতি আর দশটা সরকারি কর্মচারীর অনুপস্থিতির সঙ্গে তুল্য হতে পারে না। কারণ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক না পাওয়া অনেক সময় রোগীর জন্য জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রশ্নটি নৈতিকতারও কি নয় ? যে চিকিৎসকদের পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ এবং সম্মানী ও ভাতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের সিংহভাগ আসে সাধারণ নাগরিকের কাছ থেকে, তাদের সেবা দিতেই এত অনীহা থাকবে কেন ? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এর সমাধান কোথায় ? মন্ত্রণালয়ের আদেশ, প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযানেও যদি চিকিৎসকদের বোধশক্তি না ফেরে, তাহলে ফিরবে কীভাবে? এত আদেশ ও আবেদনের সকলই গরল ভেল! গোড়ায় কোনো গলদ রয়েছে কি-না, তাও এখন খতিয়ে দেখা জরুরি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে রোববার প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি মেডিকেল কলেজে কী পড়ানো হয়, তা তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ তদারকি করা উচিত।
নিয়োগকালেই যাতে এলাকা নির্বিশেষে সেবার প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়, সে ব্যাপারেও ভাবতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। আমরা দেখতে চাই, কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে যারাই কর্মস্থলে থাকতে অনীহা প্রকাশ করবেন, তাদের বিরুদ্ধেই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।