চালের বাজার মনিটরিংয়ের নির্দেশ জেলা প্রশাসকদের

14

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিত্যপণ্যের বাজারে কোন্ জিনিসের দাম বাড়েনি এর উত্তর খুঁজে বের করা বর্তমানে একটু কঠিনই ঠেকবে। নিত্যপণ্যের মধ্যে দামবৃদ্ধিতে যেসব পণ্য রাজত্ব চালাচ্ছে তার মধ্যে চাল অন্যতম। চট্টগ্রামসহ সারাদেশেই চালের বাজারে অস্থিরতা চলছে। চালের দামের বাড়বাড়ন্ত রীতিমত হুহু করে। চিন্তায় ফেলেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষদেরকে। আর দাম বাগে রাখতে না পেরে চিন্তায় সরকার তথা প্রশাসনও। এ কারণে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কিভাবে কমানো যায় তার উপায় হিসেবে শক্তভাবে বাজার তদারকির কথা জানিয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। এ লক্ষে তারা তদারকি কর্মকান্ডের ছক তৈরী করে ফেলেছে বলে জানালেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস।এদিকে দামবৃদ্ধির পর বাজারের অবস্থা থমথমে রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বাজারে যেমন ক্রেতার সংখ্যা কম তেমনি বিক্রেতারাও সামনে আরো দাম বাড়ার আশায় চাল ছাড়তে চাচ্ছেন না। তবে মোটাদাগে বাজারে চালের সংকটের কথা জানালেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে পাহাড়তলী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির অর্থ সম্পাদক আবদুল হাশেম জানান, দামবৃদ্ধিতে মোটা চিকন কোনোটাই বাদ পড়েনি। জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বৃদ্ধির ফল হিসেবে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে বলেও জানালেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
তিনি আরো বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। আর ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। দুইয়ে মিলে চালের বাজারের এই অস্থিরতা।
তথ্যমতে, ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। মিল মালিক ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ আড়তদারদের। তারা আমদানির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
চাক্তাই ও পাহাড়তলী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্বর্ণা সিদ্ধ চালের প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪৫০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। নাজিরশাইল নামে পরিচিত চাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে বস্তা ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়। পাহাড়তলী বাজারে জিরাশাল চাল বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। পাইজাম প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায়। মোটা আতপ চাল বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ টাকা। বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চিনিগুড়া চালের দাম। চিনিগুড়া চাল বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি ৬ হাজার টাকায়।
এদিকে চিনিগুড়া খুচরায় বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। নাজিরশাইল ৩ হাজার ৮০০, জিরাশাল ৩ হাজার ৬০০ টাকায়। স্বর্ণা (সিদ্ধ) কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়।
এ বিষয়ে পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দীন জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে মিল মালিক ও বিভিন্ন সিন্ডিকেট মিলে চালের দাম বাড়িয়েছে। মজুতদাররা চালের দাম প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছেন। এলসি করা চাল বাজারে এখনও প্রবেশ করেনি। চালের বাজারে অস্থিরতা থামবে আমদানি করা চাল বাজারে আসলে।
তথ্যমতে, চট্টগ্রামে মূলত চাল আসে দিনাজপুর, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গ থেকে। চালের বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে। আর চিনিগুড়া চাল বস্তাপ্রতি ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। মোটা সিদ্ধ চাল আগে বিক্রি হতো ১ হাজার ৮০০ টাকায়। এখন সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকায়। আর জিরাশাল চাল আগে বিক্রি হতো ৩২শ টাকায়। এখন সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। নাজিরশাইল আগে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ টাকায়। পাইজাম আগে বিক্রি হতো ২ হাজার ৪০০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায়। বলা যায় বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে চালের দাম।
বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে দাবি করে নিজাম উদ্দীন বলেন, চালের দাম ওরাই বাড়িয়ে ফেলছেন। মিল, করপোরেট ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা মিলে দাম বাড়িয়েছেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, আগে ১৩ টন ওজনের ট্রাকভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে গিয়ে হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। প্রতি বস্তায় চালের খরচ বেড়ে গেছে, যে কারণে চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে চালের পরিবহন খরচ এভাবে বেড়ে গেছে।
এদিকে ভারতীয় নাজিরশাইল চাল প্রতিবস্তা (২৫ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৫০ টাকায়। আগে এ চাল বিক্রি হতো ১ হাজার ৬৮০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। জিরাশাল এক বস্তা ভালো চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮৫০ টাকা করে। এ চালে বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে। আর মোটা আতপ বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। স্বর্ণা সিদ্ধ চালের দাম বেশি বেড়ে গেছে। আগে ২ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪৫০ টাকায়।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের বেশিরভাগ চাল আসে উত্তরবঙ্গ, আশুগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চল থেকে। এসব অঞ্চল থেকে চাল নিয়ে আসা প্রতিটি ট্রাকে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা ভাড়া বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে চালের ওপর।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, তেলের দাম কতটুকু বেড়েছে, আর চালের দাম কেমন বাড়িয়েছে খতিয়ে দেখা দরকার প্রশাসনের। সরকারের উচিত দ্রæত বাজার তদারকি শুরু করা।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২০০ অটো রাইস মিল মালিক নিজেদের ইচ্ছামতো মজুদের পাহাড় গড়ে তুলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। অটো রাইস মিলগুলো লাখ লাখ মণ ধানের মজুদ করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালের দাম নির্ধারণ করছে। এ ছাড়া কিছু মজুদদার ব্যবসায়ীও চালের মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। রংপুরের মাহিগঞ্জসহ দিনাজপুরের পুলহাট, বগুড়া, নওগাঁ ও রাজশাহী থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চাল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অটো রাইস মিলের মালিকরা চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন।
অন্যদিকে চালের বাজারের এই অস্থির অবস্থায় আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি হবে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় এ চাল বিক্রি হবে। এ কর্মসূচির আওতায় আগে ১০ টাকা দরে প্রতি কেজি চাল পাওয়া যেত। গত বাজেটে এর দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা কেজি করা হয়। গতকাল রোববার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে চাল বিক্রির ঘোষণা দেন। তিনি জানান, সেই সঙ্গে খোলাবাজারে (ওএমএস) বিক্রির জন্য চালের বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ উপকৃত হবে বলে মনে করেন মন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, দেশজুড়ে ২ হাজার ১৩ জন ডিলারের মাধ্যমে চাল খোলাবাজারে বিক্রি করা হবে। তাঁরা প্রতিদিন দুই টন করে চাল বিক্রি করবেন। আগে একজন ডিলার এক টন করে চাল পেতেন। এবার প্রত্যেক ডিলারকে প্রতিদিন দুই টন করে চাল দেওয়া হবে।
খাদ্যমন্ত্রী জানান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় থাকা ভোক্তারা মাসের হিসাবে ৩০ কেজি চাল পাবেন প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে। এ কর্মসূচিতে তালিকাভুক্ত পরিবার চাল কিনতে পারবে বলেও জানান খাদ্যমন্ত্রী।
সাধন মজুমদার বলেন, ‘১ সেপ্টেম্বর থেকে ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি একসঙ্গে চালু হলে আমি মনে করি, চালের দাম স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসবে। পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৫০ লাখ পরিবারকে মাথায় রেখে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করা হয়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে খাদ্য অধিদপ্তর। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত বিধবা, বয়স্ক, পরিবারপ্রধান নারী, নিম্নআয়ের দুস্থ পরিবারপ্রধানদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার জন্য একটি তালিকা রয়েছে।