চার বছরে হালদায় ৩১ ডলফিনের মৃত্যু

9

হাটহাজারী প্রতিনিধি

আজ ২৪ অক্টোবর বিশ্ব মিঠা পানির ডলফিন দিবস। ডলফিন একটি অতিবিপন্ন প্রাণি। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘গ্যাঞ্জীজ রিভার ডলফিন’ (Ganges River Dolphin); এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা’ (Platanista Gangetica)।
১৯৯৬ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভুক্ত দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে বিচরণকারী পরিবেশ নির্দেশক এসব ডলফিন স্থানীয়ভাবে উতোম বা শুশুক নামে পরিচিত।
দেশের অন্যতম জোয়ার-ভাটার কার্প জাতীয় মা-মাছের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হালদা নদীতে অবৈধভাবে চলাচলরত বালুবাহী নৌকা ও ড্রেজারের প্রপেলরের আঘাত, দূষণ এবং নিষিদ্ধ জালে আটকা পরে প্রতিনিয়তই অতিবিপন্ন প্রজাতির এ ডলফিনের মৃত্যু বেড়েছে। যদিও বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুসারে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। তাই ডলফিন হত্যা, বিক্রি ও ভক্ষণ দন্ডনীয় অপরাধ।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত গত চার বছরে মোট ৩১টি ডলফিন মরে ভেসে ওঠেছে হালদায় এবং এ নদীর শাখা খালে। এর মধ্যে গত ৪ অক্টোবর হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের রামদাস মুন্সিরহাট এলাকায় নদীর মাঝখানে ভাসমান অবস্থায় সর্বশেষ মৃত ডলফিনটি উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। দু-একটি বাদ দিলে প্রায় সব মরা ডলফিনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। একাধিক ডলফিন কেটে হত্যাও করা হয়েছিল। এনিয়ে বেশ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্টরা।
প্রাণি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, হালদায় এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে নদী থেকে ডলফিন বিলুপ্ত হতে পারে। বিলুপ্তির হাত থেকে ডলফিন রক্ষায় ময়নাতদন্ত ও গবেষণা বাড়াতে হবে। মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করে তা দূর করতে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি, নদী ও জলজ প্রাণি বিশেষজ্ঞরা এবং স্থানীয় জনগণকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইইউসিএন’র লাল তালিকাভুক্ত (অতি বিপন্ন প্রজাতি) একটি জলজ প্রাণি এই ডলফিন বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে আছে মাত্র ১ হাজার ১০০টি। এরমধ্যে শুধু সর্বশেষ হালদাতেই ছিল ১৭০টি। এর মধ্য থেকে গত চার বছরে মারা গেছে ৩১টি ডলফিন, যা খুবই উদ্বেগজনক মনে করছেন নদী ও জলজ প্রাণি বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, ২০২০ সালে জরিপ চালিয়ে হালদায় ১২৭টির মতো ডলফিন মিলেছিল। এর দুই বছর আগে ২০১৮ সালের জরিপে নদীতে ডলফিনের উপস্থিতি ছিল ১৬৭টি। এছাড়া ২০১৭ সালে ২০০টি ডলফিনের অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করেছিল জরিপ কাজের সাথে সংশ্লিষ্টরা। তবে উদ্বেগজনক হলেও সত্য, মাত্র চার বছরে ৩১টি ডলফিনের মৃত্যু একে শঙ্কার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ড. মনজুরুল কিবরিয়া আরও জানান, ডলফিনগুলো রক্ষা করা না গেলে হালদা ডলফিনশূন্য হয়ে যাবে। ডলফিন বাঁচাতে নদী তীরের বাসিন্দাদের সচেতনতাই একমাত্র পথ।
তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থা সক্রিয়। গত বছরগুরোতে আঘাত জনিত ও নদীর তীর রক্ষায় বসানো বøকে এবং নদীতে চলাচলকারী নৌযানের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডলফিনগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত করা গেছে। তবে স¤প্রতি মৃত ডলফিনগুলোর শরীরে তেমন আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি। হয়তো মাছ শিকারীদের অবৈধ জালে আটকা পড়লে বেশিক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পেরে ডলফিনগুলো মারা পড়ছে।
এ ব্যাপারে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহিদুল আলম বলেন, হালদার হাটহাজারীর সর্ত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা এসব ডলফিনের মূল নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র। এ ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবৈধভাবে জাল ফেলে স্থানীয় মৎস্য শিকারীরা। বাইরের কেউ এসে মাছ শিকার করে না। স্থানীয়রা যদি ডলফিন ও মা মাছ রক্ষায় সচেতন না হন, তাহলে পরিস্থিতি হবে খুব ভয়াবহ। তাছাড়া এসব মৎস্য শিকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।
এ পরিস্থিতিতে আজ হাটহাজারীতে দ্বিতীয় বারের মতো ‘বিশ্ব মিঠা পানির ডলফিন দিবস’ পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে হালদা নদীর ডলফিন রক্ষার উদ্যোগে চট্টগ্রাম বন বিভাগ (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) কর্তৃক হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারায় ড. শহীদুল্লাহ একাডেমীতে সচেতনতামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
প্রসঙ্গত, ডলফিন পরিবেশের একটা ইনডিকেটর। পরিবেশ ভালো না থাকলে ডলফিন টিকতে পারে না। এদের শরীরের গঠন নরম প্রকৃতির। ডলফিনের গর্ভকাল প্রায় ১০-১১ মাস। প্রায় ২ বছর পরপর একটি মাত্র বাচ্চা দেয়। ৯-১০ বছর বয়স হলে বাচ্চা দিতে শুরু করে। এদের জীবনকাল সর্বোচ্চ ২৫ বছর। এরমধ্যে শেষ ৫ বছর বাচ্চা দেয় না ডলফিন। সে হিসেবে একটি ডলফিন তার জীবনকালে হয়ত সর্বোচ্চ ৫-৬টি বাচ্চা দিতে পারে।