চার দশকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবায় আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক

91

লায়ন ম. মাহমুদুর রহমান শাওন

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল- দেশের স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য অবদান রেখে চলেছে। চিকিৎসা খাতের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এ প্রতিষ্ঠানটির কথা। প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ, প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য জনবল, সঙ্গে আছে নানা সমস্যা-সংকট। আছে নানা সীমাবদ্ধতা। তবুও প্রতিষ্ঠানটি নিজের সক্ষমতা, সীমিত সামর্থ্য এবং অপ্রতুল চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কেবল চট্টগ্রাম নয়, চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষদের স্বাস্থ্য সেবায় আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যা। কিন্তু রোগ ও রোগীর বিপরীতে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র অপ্রতুল। ফলে প্রতিদিনই মা ও শিশু হাসপাতালে আসছে রোগী। কিন্তু রোগীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিতে দেওয়ার মত সক্ষমতা নেই এ হাসপাতালের। ফলে প্রতিনিয়তই আসে অভিযোগ। এরপরও সীমিত জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে বেসরকারি এ হাসপাতালটি।
১৯৮৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা হয়। বেসরকারিভাবে গড়ে উঠা হাসপাতালটি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চট্টগ্রামের লাখ লাখ অসহায় ও দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে যে হারে এটি স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে, সে তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম-খ্যাতি অনেক মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছেনি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. এ এস এম ফজলুল করিমসহ চট্টগ্রামের কয়েকজন মানবতাবাদী মানুষ নিজ উদ্যোগের প্রতিফলন আজকের এই বিশাল পরিসরের সেবাকেন্দ্র। শুরুর দিকে কেবল বহির্বিভাগে সীমিত পরিসরে চিকিৎসাসেবা দেয়া হলেও চার দশক পর এসে চিকিৎসক-কর্মচারী সকলের সমন্বিত প্রয়াসে প্রায় তের শতাধিক ব্যক্তির কর্মমুখরতায় চিকিৎসাসেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।
স্বল্প খরচে সহজে চিকিৎসা সেবা পাওয়া একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামে এক সময় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা ছিল অপ্রতুল। বিশেষায়িত মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান এখানে বলতে গেলে তেমন ছিল না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা আন্দরকিল্লাস্থ জেনারেল হাসপাতাল, এ দুইটি হাসপাতালের পক্ষে বৃহত্তর চট্টগ্রামের কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিশু এবং মায়েদের জন্য চট্টগ্রামে কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল ছিল না। আর এই প্রয়োজনীয়তা ও শূন্যস্থানটি পূরণ করলো চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।
প্রসূতি মা ও নবজাতক শিশুদেরকে নানাবিধ রোগ নিরাময়ে বিশেষায়িত মা ও শিশু হাসপাতালটি কতো বড় ভূমিকা রাখছে, তার একটি ছোট্ট বাস্তব ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রামে মাতৃমৃত্যু ঠেকাতে ও শিশু মৃত্যু রোধে এই হাসপাতালের ভূমিকা অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মতো একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এখানে আছে বলেই তো প্রতিদিন শত শত শিশুসহ বিভিন্ন ধরনের অসহায় গরিব রোগীরা সহজে ও সুলভ খরচে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছে।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল জনসাধারণের অর্থ অনুকূলে পরিচালিত মানবসেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান। আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে এর গোড়াপত্তন। অন্য দশটি বেসরকারি হাসপাতালের মতো এখানে বাণিজ্যিক বা লাভজনক কোনো ব্যাপার নেই। এখানে শুধু চিকিৎসার বিনিময়ে রোগীর কাছ থেকে খরচটুকুই নেয়া হয়। প্রকারান্তরে রোগীদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে সর্বোচ্চ ছাড়ও দেওয়া হয়। হতদরিদ্রদের চিকিৎসায় হাসপাতালের একটি যাকাত ফান্ড আছে। নিতান্তই গরিব অসহায় রোগীদেরকে যাকাত ফান্ড থেকে বিনা খরচে চিকিৎসা সেবাসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনে দেওয়ার মতো মহৎ কাজ উদ্যোগও রয়েছে এ হাসপাতালের। হাসপাতাল কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হতে পারে না, গরিবও চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকার আছে- চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল এই প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ৪০ বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি গরিব ও অসহায় মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসার ঠিকানা হয়ে উঠেছে। স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা সেবার মাধ্যমেও গরিব রোগীদের জন্য চিকিৎসা ব্যয়ের ছাড় দেয় এরকম কয়টি হাসপাতাল দেশে রয়েছে?
চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল ৬৫০ শয্যার একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। হাসপাতালের বহির্বিভাগ ছাড়াও রয়েছে শিশু আইসিইউ, এনআইসিইউ, এডাল্ট আইসিইউ, সিসিইউ, কিডনি ডায়ালাইসিস, ইউরোলজি, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা ইউনিট, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, গ্যাস্ট্রোএন্টারলজি ইউনিট, শিশু কিডনি রোগী ইউনিট, থেলাসেমিয়া ইউনিট, অনকোলজি ইউনিট, এডাল্ট নিউরোলজি, শিশু কার্ডিওলজি, ল্যাবরেটরি সার্ভিস, বøাড ব্যাংক। এক কথায় একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র। শিশু রোগী ছাড়াও বর্তমানে সকল বয়সী রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। প্রায় ৯ হাজার আজীবন সদস্য হাসপাতালের যাবতীয় কার্যক্রম নিয়মিতভাবে বুলেটিনের মাধ্যমে অবহিত হয়ে থাকে। এ বুলেটিন নিয়মিতভাবে হাসপাতালের ওয়েব সাইটে আপলোড করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসেবা আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ৮৫০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। ১৪ তলা বিশিষ্ট ভবনটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন হাসপাতাল ভবনটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। শীঘ্রই নবনির্মিত ভবনে এ হাসপাতালের আউটডোর সেবা চালু করার প্রত্যয় নিয়ে নির্মাণ কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল একটি বিশাল প্রকল্প। ৪০ বছরে এগিয়েছে অনেক দূর। হাসপাতালটি শুধু মা ও শিশু চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রূপান্তরিত হয়েছে জেনারেল হাসপাতালে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠা করেছে ১১০ আসনের চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ, ৫০ চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল নার্সিং ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ইনস্টিটিউট অব চাইল হেলথ, ৫০ চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল নার্সিং কলেজ (বিএসসি নার্সিং)।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের একটি বড় প্রকল্প হিসেবে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান নির্বাহী কমিটি। সমাজের বৃত্তবান ও সমাজ হিতৈষীদের সহায়তায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয়েছে বাস্তবায়ন কমিটি। বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সৈয়দ মোরশেদ হোসেন, রেজাউল করিম আজাদ, ড. মুহাম্মদ সানাউল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার জাবেদ আবছার চৌধুরী, এস এম কুতুব উদ্দিনসহ কার্যনির্বাহী কমিটি মানবতার সেবায় নিরলস কাজ করা যাচ্ছেন। তাদের ত্যাগ ও অবদানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল এক বিশাল মহীরূহ হয়ে উঠেছে। সেই সেইসব মানবব্রতী কীর্তিমান ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক