চামড়া নিয়ে নয়ছয়

123

ঔপনিবেশিক আমল থেকে এই ভূখন্ডে অর্থনৈতিকভাবে চামড়া শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে চামড়া শিল্প একটি লাভজনক খাত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চামড়া শিল্পের অবস্থান রপ্তানিখাতে দ্বিতীয়। সেই বিবেচনায় দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অংশীদার হিসেবে চামড়া শিল্পের প্রতি সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাই তথা ব্যবসায়ীদের সুনজর থাকা বাঞ্চনীয়। বিগত কয়েক বছর চামড়া নিয়ে কম-বেশি নয়ছয় হয়েছে। এই বছর চামড়া নিয়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা বর্ণনা করা অনেক কষ্টের। ট্যানারি মালিকেরা আড়তদারদের যোগসাজশে যে নাটকের অবতারনা করেছেন, তা দেশের অর্থনীতির উপর চপেটাঘাত। বলতে গেলে চামড়া নিয়ে কারসাজির কারণে ৫০০ কোটি টাকা রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ- পূর্বে এবং বর্তমানে চামড়া শিল্পে প্রদত্ত ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৭৭০৭ কোটি টাকা। এই ঈদে কাঁচা চামড়া কেনার জন্য ট্যানারি মালিকদের ঋণ দেওয়া হয়েছে ৩৬১২ কোটি টাকা। ৭৭০৭ কোটি টাকার মধ্যে ৮০% শতাংশ ঋণ খেলাপি। বলাবাহুল্য, রপ্তানিমুখি চামড়া শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সার্কুলার জারি করে ব্যাংক ঋণের সুধ ৭% শতাংশ ধার্য করে। অন্যান্য খাতে যখন ১০%-১২% শতাংশ সুদের হার তথায় ৭% শতাংশ সুদের হার অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।


ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চামড়া বেচাকেনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলোচনা করে প্রতি বর্গফুট ভিত্তিতে ক্রয়মূল্য নির্ধারিত করে দিলেও ট্যানারি মালিকেরা তা আমলে নেননি। ঈদের দিন থেকে চামড়া কেনার ব্যাপারে তারা অনাগ্রহ প্রকাশ করে। আড়তদার এবং ট্যানারি মালিকদের টানাপড়নে চামড়া নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাতে মৌসুমী খুচরা ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে পড়ে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাজার হাজার খুচরা ব্যবসায়ী অনিশ্চিতের পথে পা বাড়িয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে মসজিদ, মাদ্রাসা এবং এতিমখানাও বাদ পড়েনি। মুল ব্যবসায়ীরা দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে, একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে। এ পর্যায়ে চামড়া শিল্প অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। চামড়া নিয়ে হয়রানির শিকার হয়ে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ বেশ কিছু এলাকায় হাজারের অধিক চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। অনেকে প্রকাশ্যে রাস্তায় চামড়া ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আমাদের জানামতে লাখ টাকার গরুর চামড়া তিনশত টাকায় বিক্রি করেছেন। চামড়া ক্রয়-বিক্রয় নির্ভর করছে ট্যানারি মালিকদের মর্জির উপর। কেননা তাদের হাতে আমরা জিম্মি। সরকার বিষয়টিকে নমনীয়তার সাথে নিয়েছেন। মূলতঃ সরকারের পক্ষ থেকে বেঁধে দেওয়া দরের উপর ট্যনারী মালিকেরা বিশ্বাসী ছিলেন না বলে চামড়া নিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
আড়তদারদের দাবি, ট্যানারি মালিকদের কাছে তাদের পাওনা ৪০০ কোটি টাকা। পাওনা টাকার ব্যাপারে দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকলেও এই ঈদে ভর করেছে, ট্যানারি মালিকদের উপর। তবে আড়তদারদের পাওনা টাকা পরিশোধ করার ব্যাপারে ট্যানারি মালিকদের গড়িমসি, চামড়া শিল্প বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। চামড়ার দাম নি¤œমুখি, এ কথাও বিভ্রান্তি ও দূরভিসন্ধিমূলক। ট্যানারি মালিকদের আকস্মিক এহেন আচরণের কারণে আড়তদারদেরও বিরাট অংশ চামড়া কেনার ব্যাপারে নিরবতা পালন করে। যার জন্য ঘটে বিপত্তি। চামড়া নিয়ে এতটা অনাগ্রহ পূর্বে কখনও দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, চামড়া কিনতে দেওয়া ঋণের এত টাকা গেলো কোথায়? তাহলে এই টাকা কি পাচার হচ্ছে? তাঁদের মতে চামড়া কেনার জন্য প্রদত্ত টাকার বেশীর ভাগ অংশ ইতোমধ্যে হাওয়া হয়ে গেছে, তা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে, আমাদের বিশ্বাস। তথাকথিত সিন্ডিকেট এবং মদদদাতাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে ভবিষ্যতের পথ সুগম করা অপরিহার্য। নতুবা চামড়া শিল্পের অগ্রগতি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। চামড়ার অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে কঠোর আইনের প্রয়োগ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ট্যানারি শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক না হয়ে বিকেন্দ্রীকরণের কথা ভাবতে হবে সরকারকে। চামড়া কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্যের মান এবং রপ্তানীযোগ্য পণ্যের উপর সরকারের পক্ষ থেকে তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। চামড়ার বহুমুখি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্থ এবং চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের আর্থিক যোগান না দিয়ে চামড়া শিল্পকে ঝুঁকির কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ-ট্যানারি খাতে বহুল আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রæপের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচারের মামলা চলছে। চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়ে ও কেনার ব্যাপারে তালবাহানা এবং আড়তদারদের বকেয়া পাওনা না দেওয়ার ব্যাপারে ট্যানারি মালিকদের গড়িমসি, সত্যিই দুঃখজনক । চামড়া শিল্পের এ ক্রান্তিকালে সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানীর সিদ্ধান্ত নিয়েও ট্যানারি মালিকদের অনুরোধে সিদ্ধান্ত চাপা রাখে। সেক্ষেত্রে ১৭ তারিখ থেকে চামড়া কেনার কথা থাকলেও ট্যানারি মালিকরা তা কৌশলে এড়িয়ে চলে।
চামড়া নিয়ে নয়ছয় করে যারা রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন বুনেছেন। সত্যিকার অর্থে আপনারা কি লাভবান হয়েছেন। বস্তুতঃ মাঝপথে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের সাথে আড়তদারদের দূরত্ব এবং আড়তদারদের সাথে ট্যানারি মালিকদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকেরা অযুহাত সৃষ্টিকল্পে গত বছরের চামড়া মজুদ করে রেখেছে। চামড়া শিল্পে উদ্ভুত সংকটময় পরিস্থিতির কারণে সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণ করা হয়নি এবং করা যাচ্ছেনা। একদিকে চামড়ার মান ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ভাল মানের চামড়া না হলে আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়বে। চামড়া আমাদের জাতীয় সম্পদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক চামড়া শিল্পের প্রতি আরো কঠোর নজরদারি, আমরা প্রত্যাশা করি। চামড়ার গুণগত মান এবং সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের উপর বর্তায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক