চাপের স্থান-কাল-পাত্রভেদ তত্ত্ব

14

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

এমন মানুষ আছে ক’জন পৃথিবীতে, যারা বলতে পারেন, কোনো চাপই অনুভব করছি না? চাপে ভরা এই বিশ্ব, চাপ কোথায় নাই? ঘরে চাপ, বাইরে চাপ, কাজে চাপ, বাজারে চাপ, অফিসে বসের চাপ, দেশে জনসংখ্যার চাপ, বাসে মানুষের চাপ, সাগরে নিচাপ, পাহাড়ে উচ্চচাপ, স্থলে বায়ুরচাপ, দিলে মানসিকচাপ, শরীরে রক্তের চাপ। আরো আছে আমলার চাপ, কামলার চাপ, হামলার চাপ, মামলার চাপ, পুলিশের চাপ, মন্ত্রীর চাপ, চাপরাশির চাপ এমন হাজারো চাপ। এত চাপে ভরা এই ধরা, এই ধরাধামে দাঁড়িয়ে যখন কেউ বলেন, আমি কোনো চাপ অনুভব করছি না, তখন তারে বলা যায়। কি বলা যায়? কবিগুরুর মহান বাণীটি মনে পড়ে গেল, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়।’উল্লেখিত উক্তিটি আমাদের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাহেবের। তিনি কোনো চাপ অনুভব করছেন না। এমন চাপে ভরা বিশে^, এতো উচ্চ চাপের জনসংখ্যার দেশে তারে বলা যায়, এমন চাপে কি আছে জনাব কি লয়েছেন স্বীয় অঞ্জলি ভরি? কি পেয়েছো সখা ভব জীবন চরি, শত জনমের চাপ লঙ্ঘিত করি, কোন চাপই আজি তব জীবনে নাহি, হিহিহিহি!
বিষয় হচ্ছে আমাদের সিইসি চাপের মধ্যে থেকেও কোনো চাপ অনুভব করছেন না, আর যেদিন তিনি একথা বললেন সেদিনই কি এক অজানা চাপে তথ্য সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হল। বলা হল তথ্য সচিব কোথায় কার সাথে কি দেখা করতে গেল, তা থেকে এই চাপ সৃষ্টি হল। চাপের অনেক রকম ফের আছে, বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন ধরণে চাপের সৃষ্টি হয়। আবার বিভিন্ন চাপ বিভিন্ন ক্রিয়া করে, যেমন সাগরে নিম্নচাপের কারণে তুফান, সাইক্লোন, জলোচ্ছ¡াস, ইত্যাদি হয় আর সে তাÐব ‘সিত্রাং’ ইতিমধ্যে দেখিয়েগেল। শরীরে রক্তের উচ্চচাপের কারণে হার্টএ্যাটাক, অফিসে বসের চাপের কারণে চাকরি নট অথবা প্রমোশন কট। ফলে চাপ এক অদ্ভুত প্রপঞ্চ, চাপছাড়া কোনস্থান নেই সর্বক্ষেত্রে চাপ বিদ্যমান। আর চাপ হল একক ক্ষেত্রফলে কোন বস্তুর তলের উপর লম্বভাবে প্রযুক্ত সমভাবে বিতরিত বল। চাপের একক প্যাসকেল, প্রতিবর্গমিটারে চাপকে বলা হয় নিউটন ও বর্গইঞ্চিতে পাউন্ড। কাজেই চাপ অনুভব করতে না পারার কোন উপায় নাই। কারণ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে চাপ বুঝা যায়, এটাই হল চাপের ধর্ম। এমন কার্যকরী ধর্মাচারি চাপের সাগরে থেকে সিইসি চাপ অনুভবই করতে না পারার কারণ কি হতে পারে? হতে পারে অনুভূতিহীনতা কিংবা অতি সহিষ্ণুতা, হাহাহাহা।
সারাবিশে^ দেখুন কত চাপের ছড়াছড়ি, রাশিয়ার চাপে ইউক্রেন বেদিশা, চীনের চাপে তাইওয়ান, আমেরিকার চাপের বাইরে নো ওয়ান, আর আমরা তো আছি ভারত-বার্মার মিলিত চাপে। কদিন হল মাত্র বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হলেন লিজ ট্রাস, এরমধ্যেই পড়ে গেলেন তিনি ভীষণ চাপে, সেইচাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট, গদি চলে গেল সেই কবে, মামলা পিছু ছাড়ছেনা। মামলার চাপে আজ বড় জর্জরিত বেচারা দম ফেলার অবসর পাচ্ছেন না। অবশ্য তাঁরকথা বলে লাভ নেই, কারণ ইতিমধ্যে তিনি খ্যাপাটে, পাগলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছেন। তবে পাগল আর ছাগল যা’ই বলেন, চাপ কিন্তু কাউকে ছাড়ে না। সেদিন এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা, জিজ্ঞেস করলাম, দোস্ত কেমন আছিস? দোস্ত গুমসে মুখে, বলিস না দোস্ত ভীষণ চাপে আছি। কেন কি হয়েছে? একজনকে দশলাখ টাকার চেক দিলাম, পাস হয়নি, ব্যাটা মামলা করেদিয়েছে। পুলিশ আমাকে খুঁজছে এখন পাগলা কুত্তার মত, কি যে করি কিছু বুঝতে পারছি না দোস্ত। শুনে তো নিজেই উল্টা চাপে পড়ে গেলাম। কারণ এখন যদি আমার কাছে উধার চেয়ে বসে সে? প্রসঙ্গ পাল্টে কোনক্রমে কেটে বাঁচলাম।
আসলে চাপের কোন টাইমট্যাবল নাই, যে কোন সময়, যে কোন জায়গাতে চলে আসতে পারে সে। অন্যের সুখ-দুঃখের খবর তার কাছে নাই, বাগে পেলেই আর রক্ষে নেই। তেমন একটি চাপ হল মাটির চাপ। কবরে নাকি লাশ রেখে চল্লিশ কদম চলে আসার পর মাটি লাশকে এমন দুই চাপ দেয় যে, সে চাপে মুর্দার ডানের হাড্ডি বামে আর বামের হাড্ডি ডানে চলে আসে। সুতরাং চাপের কোন অন্ত নাই, যেখানে যাই সেখানে চাপের দেখা পাই। তবে সবচাপ কিন্তু খারাপ না, কিছু চাপ অনেক মূল্যবান রতœ তৈরী করে। যেমন হীরা, ভূগর্ভের প্রচÐ তাপ এবং সেই সাথে অতি উচ্চ চাপের কারণে কয়লা হীরায় পরিণত হয়। ভেবে দেখুন মামুলি কয়লা যার দুপয়সা দাম নাই শুধুমাত্র চাপের কারণে হাজার কোটি টাকা মূল্যের কোহিনূরে পরিণত হয়। অতএব চাপ এমন একটি জিনিস, যা মানিকে হানি বানায় আর হানিকে মানি বানায়। তাই চাপকে অস্বীকার করার কোন জো নাই কিন্তু তথাপি আমাদের সিইসি হাবিব সাহেব চাপকে প্রবলভাবে অস্বীকার করেছেন। কি আশ্চর্য, এত চাপের মধ্যে থেকে তিনি চাপ অনুভব না করে থাকতে পারেন কেমন করে! মূলত তিনি চাপ অনুভব করেন না কেন? হতে পারে তিনি চাপকে চেপে যান।চাপ হতে আসে চাপা, চাপার জোরে চাপ দিয়ে তাকে, চাপকে দেন মাটি চাপা, হাহাহা।
অবশ্য চাপ প্রয়োগের তীব্রতার উপরও চাপ অনুভবের বিষয়টা নির্ভর করে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে চাপ ভিন্নতর হয়, যেমন বø্যাকহোলের চাপ। এচাপ এতই প্রচÐ যে, তার মধ্যে যদি গোটা হিমালয় পর্বতকে প্রবেশ করানো হয়, তবে তার প্রচÐ চাপে হিমালয় একটি চালের দানার সমান হয়েযাবে! সেইদিকে না যাই, কারণ বø্যাকহোল নাম শুনলেই ভয় লাগে। তার চাইতে চলুন কবিতাতে যাই, দেখি চাপনিয়ে কবিতাতে কিছু আছে নাকি। জীবন নিয়ে যখন পরবে মাইনকা চিপায়, খুঁজে পাবেনা কোন উপায়, হঠাৎ আসা মাইনকাচিপা, জীবন লাগবে তখন তিতাÑহঠাৎ কষ্টের চাপ কবিতার কটি লাইন, কবি বিধান রায়। তবে ‘চাপ’ নামে একটি কবিতা, লিখেছেন ওসমানী, চাপের বিশদ বিবরণ তিনি তাতে দিয়েছেন। ঘরের চাপ, অফিসের চাপ, বয়সের চাপ, বাজারের চাপ, বসের চাপ, বউয়ের চাপ, রক্তের চাপ, ভক্তের চাপ, বায়ুর চাপ, ¯œায়ুর চাপ, গাড়ির চাপ, বাড়ির চাপ, নারীর চাপ, ইত্যাদি প্রচুর চাপের কথা তিনি সেখানে লিখেছেন। আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ কি কখনো কোনচাপ অনুভব করেছিলেন নাকি? সম্ভবত করতেও পারেন, নইলে কেন লিখলেন তিনি, বল দাও মোরে বল দাও প্রাণে দাও মোর শকতি। চাপে না পড়লে কেউ কি শুধু শুধু বল চায় নাকি, হিহিহিহি? কাজেই বলা যায় রবীন্দ্রনাথ আরো বড় চাপে পড়েছিলেন।
সেদিন ইউটিউবে একটি গান শুনলাম, ও পাকা ধানে মই দিল কে কন রে মাইয়্যা কাটা ঘায়ে নুন ছড়াইস না। ও নাগর ওরে চেপে যা চাপ নিস না। আচ্ছা এটি কি কোন কথা? তার সর্বনাশ করে তাকেই বলছে চাপ না নিতে। চুরি আরো সিনা জুরি, এই চাপ কি চাপা যায়? তার পাকাধানে মই দিয়ে তাকে বলছে চেপে যেতে। আচ্ছা সে কি সিইসি যে, এতবড়ো চাপ চেপে যাবে? সুন্দরীদের নিয়ে হয়েছে এই এক জ¦ালা। দিতে কষে দিবে চাপ আর বলবে, চেপে যা চাপ নিস না!তবে চাপ যে সর্বদা সুন্দরী আর ক্ষমতাবান থেকে আসে, তা কিন্তু না। অনেক দুর্বলও প্রবল চাপ তৈরী করতে পারে। যেমন কিছুদিন আগে পত্রিকাতে দেখি, প্রতাপ, প্রতিপত্তি, প্রবল প্রভাবশালী অবস্থান হতে বলাহল, খালেদা জিয়ার মত কেউ যেন ক্ষমতায় না আসে। বুঝলাম বেশ দুর্বল প্রভাবও প্রবল প্রতাপকে প্রচÐ চাপে ফেলতে পারে। সিংহ যেমন ইঁদুর কর্তৃক ঋণী হতে পারে, হাতিও চামচিকের লাথি খেতে পারে। অবশ্য ইহাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ, বুদ্ধিমানরা কখনো কাউকে দুর্বল ভাবে না,মূর্খরা শত্রæকে দুর্বল মনে করে। বছর কয় আগে একটি গান বড়ই জনপ্রিয় হয়েছিল অর্থাৎ ভাইরাল হয়েছিল আর কি। আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়, আমার দিলের চোট বুঝে না কোন হালায়Ñশ্মশ্রæমÐিত হায়দার হোসেনের গাওয়া।
প্রকৃতপক্ষে হায়দারের এই গানটি বেশ বাজার গরম করেছিল এবং এখনও জনপ্রিয়, কারণ গানটির মধ্যে সত্যতথ্য আছে। আর সত্য সবের আবেদন স্থায়ী হয়। সত্য এবং জীবন-ঘনিষ্ঠ সব বিষয় মানব হৃদয়ে চিরস্থায়ী আবেদন ফেলতে সক্ষম। কিন্তু মিথ্যা আর চাপাবাজি পারেনা। তাই সিইসির কথায় সবাই রস বোধ করেছে, যশ ভোগ করেনি। কারণ এত চাপকে যখন তিনি চেপে গেছেন, সকলে মেপে মেপে চরম ক্ষেপে গেছেন। সুতরাং মহোদয়গণ, চাপ নিয়ে এতক্ষণ প্রচুর প্যাঁচাল তো পাড়লাম। এবার চাপের আসল রসটা নিতে না পারলে চাপের মূল ভাবটাই যে অধরা থেকে যায়। এত কথা বলার পরও মনে হবে কথা শেষ হইয়াও হইলনা শেষ। কারণ চাপের শেষ ঝাঁপসুরের জাদুকর, কণ্ঠের কারুকার, গজল স¤্রাট মেহেদী হাসানের সুললিত সুরলহরিতে উৎসারিত। আহা, সঙ্গীতের কি মদিরতা মেহেদীর কণ্ঠের মোলায়েম আবেশ হতে মুক্তোদানার মত কর্ণগভীরে সুরের নির্যাস ছড়ায়Ñ‘তেরি হর চাপ সে জ¦লতে হ্যাঁ খায়ালুঁ ম্যাঁ চিরাগ, জব ভি তু আয়ি জাগাতা হোয়া জাদু আয়ি, তুঝকো ছু লুঁ তো ফির এ্য জানে তামান্না মুঝকো, দের তক আপনে বদন সে তেরি খুশবু আয়ি, তো বাহারোঁ কা হ্যা উনওয়ান তুঝে চাহুঙ্গা, ম্যাঁ তো মর কর ভি মেরি জান তুঝে চাহুঙ্গা, জিন্দেগী ম্যাঁ তো সভি পেয়ার কিয়া করতে হ্যাঁ।’
আহ্ কি কথা, সুরলহরি হয়ে মেহেদীর সুললিত কণ্ঠ হতে ঝরে পড়ছে। যেমন কথা তেমন তার সুর। এখানে চাপ অর্থ পদধ্বনি। অতএব উক্ত চরণে যা বলা হল, ‘তোমার পায়ের প্রতিটি শব্দ আমার চিন্তাকে প্রজ¦লিত করে তোমার উপস্থিতি জাদুময় আবেশ সৃষ্টিকরে। হে আমার প্রাণেশ^রী তোমাকে ছুঁলে পর দীর্ঘ ক্ষণ ব্যাপী আমার দেহ হতে তোমার সৌরভ নিঃসৃত হয়। বসন্ত বলে তুমিই সে, যাকে আমি প্রচÐ ভালোবাসি। হে প্রিয়তমা আমি মরে গিয়েও তোমাকে ভালবেসে যাব। জীবনে সবাই তো প্রেম করে যেতে থাকে।’ আহ্ কি সুর, আর কি তার চাপ, শরীর-মনে প্রশান্তি নেমে আসে। এই চাপেই রয়েছে একস্বর্গীয় অনুভূতি, যা আমাদের সিইসি অনুভব করেন না, হাহাহাহা।
লেখক : কলামিস্ট