চাটগাঁইয়া ‘উ-নি’ ডাবল দামে কিনি

43

সবুর শুভ

শতশত বছরের ঐতিহ্যের শুঁটকিতে বাংলাদেশ এখন পরনির্ভর। এ শিল্পে এক সময়ের রপ্তানিকারক বাংলাদেশের ললাটে এখন আমদানিকারক দেশের তকমা। এ কারণে গেল পাঁচ বছরে শুঁটকির দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। দেশে প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে চাহিদা। কিন্তু নানা কারণে উৎপাদন চলছে তার উল্টো রথে। দেশে এখন ৭০ শতাংশ শুঁটকি আমদানি করতে হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে শিল্পটি। অন্যদিকে ভোক্তাদের বেশি টাকায় কিনতে হচ্ছে আমদানিকৃত নিম্নমানের শুঁটকি। এসব শুঁটকিতে আবার বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।
দেশের বৃহৎ শুঁটকির বাজার চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বছর বছর সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। শুঁটকি শিল্প মূলত সামুদ্রিক মাছের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া সাগরে জলদস্যুদের আক্রমণ, মাছ ধরা থেকে শুরু করে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলারা পেশা বদল করছে। ফলে বছর বছর শুঁটকির প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ বাড়লেও সেই অনুপাতে উৎপাদন না বাড়ায় পণ্যটির দাম বাড়ার প্রবণতা থামছে না।
ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মতে, আসাদগঞ্জ পাইকারি বাজারে ৪০টি শুঁটকির আড়ত ও ২৬৮টি পাইকারি দোকান রয়েছে। আড়ত ও দোকান মিলে প্রতিদিন গড়ে বিক্রি দেড়শ টনেরও বেশি। আড়ত ও দোকান মিলে দৈনিক টার্নওভার প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে শুঁটকি আসে এসব আড়ত ও দোকানে। বর্তমানে প্রতিবছর দেশে শুঁটকির চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত শুঁটকি দিয়ে প্রায় ২০ হাজার টনের চাহিদা মেটানো হয়। বাকি প্রায় ৩৫ হাজার শুঁটকি আমদানি করতে হয় মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে। যা মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ। এ অবস্থায় এক সময়ের রপ্তানিকারক দেশ বর্তমানে শুঁটকিতে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন আছাদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসমান হায়দার রানা।
কাস্টমস ও আমদানিকারকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে ২০০১-০২ অর্থবছরে শুঁটকি রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন। যা ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে এসে কমে আসে ৩ হাজার মেট্রিক টনে। ২০০৭ সাল থেকে শুঁটকির উৎপাদন কমতে থাকায় রপ্তানিও কমতে থাকে। ২০১১-১২ অর্থ বছরে শুঁটকি রপ্তানি কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৫০ মেট্রিক টনে। একই বছরে আমদানি করা হয় ৫৩৬ মেট্রিক টন। তারপর থেকে প্রতিবছর আমদানি বেড়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৪ হাজার মেট্রিক টনে। বর্তমানে আমদানি বাড়তে বাড়তে তা ঠেকেছে ৩৫ হাজার টনে।
এ বিষয়ে আছাদগঞ্জ শুঁটকি আড়তদার সমিতির আহŸায়ক ইদ্রিস আলম জানান, দেশে তৈরি শুঁটকির গুণগত মান ভালো। খেতেও সুস্বাদু। তাই মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডনসহ অনেকগুলো দেশে চট্টগ্রামের শুঁটকির চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে তৈরি শুঁটকির ২০ শতাংশ এসব দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তবে এরমধ্যে রাঙ্গাবালি ও সোনাদিয়া এলাকার শুঁটকির গুণগত মান বেশ ভালো।
ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য মতে, প্রতি বছরে সব ধরনের শুঁটকিতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ দাম বাড়ছে। সেই হিসেবে, প্রতি পাঁচ বছরে শুঁটকির দাম হচ্ছে দ্বিগুণ। গেল পাঁচ বছরে তাই হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে বর্তমানে মানভেদে প্রতিকেজি লাক্ষ্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৩০০০-৩৫০০ টাকায়। পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৫-২০১৬ সালে প্রতিকেজি লাক্ষ্যা বিক্রি হতো সর্বোচ্চ ২০০০-২৫০০ টাকায়। মানভেদে প্রতিকেজি রাঙ্গাবালির রূপচাঁদা বিক্রি হচ্ছে ২৯০০-৪০০০ টাকা দরে। পাঁচ বছর আগে এই শুঁটকি বিক্রি হতো মাত্র ১৮০০-২০০০ টাকায়। গত চার-পাঁচ বছর আগে কেজি ১০০০-১৫০০ টাকায় ভালো মানের কোরাল শুঁটকি পাওয়া গেলেও বর্তমানে বিভিন্ন মানের কোরাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ২৭০০-৩০০০ টাকার মধ্যে। তাছাড়া অন্যান্য শুঁটকিগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ২০ শতাংশ দাম বেড়ে বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন মানের চিংড়ি কেজি ১৬০০-১৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত পাঁচ বছর আগে ছিল ৭০০-৮০০ টাকার মধ্যে। পদ্মার নোনা ইলিশ আকার ও মানভেদে প্রতি পিস ৩০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ বছর আগে প্রতিটি আস্ত নোনা ইলিশ বিক্রি হতো সর্বোচচ ১০০-২০০ টাকায়। বাজারে বিভিন্ন মানের লইট্ট্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৫০-৯০০ টাকায়। এরমধ্যে রাঙ্গাবালির লইট্ট্যা ৬৫০টাকা, সোনাদিয়ার লইট্ট্যা ৫৫০, ইন্ডিয়ান লইট্ট্যা ৭৫০-৮০০ টাকা এবং মিয়ানমারের লইট্ট্যা ৮৫০-৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইস্স্যা শুঁটকির মধ্যে মান ও আকারভেদে রাঙ্গাবালির পাইস্স্যা কেজিপ্রতি ৬০০ টাকা, সোনাদিয়ার পেইস্স্যা ৪০০ এবং ইন্ডিয়ান পাইস্স্যা ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে রাঙ্গাবালির ছুরি শুঁটকি কেজি ১৩০০-১৫০০ টাকা, সোনাদিয়ার ছুরি ১০০০-১২৫০ টাকা এবং পাকিস্তানি ছুরি ৪৫০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য শুঁটকির মধ্যে রাঙ্গাবালির পোপা শুঁটকি ৭৫০ টাকা, সোনাদিয়ার পোপা ৬০০ টাকা এবং পাকিস্তানি পোপা ৮৫০-১০০০ টাকা দরে কেজি বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে। এছাড়া রাঙ্গাবালির রিসকা শুঁটকি ৫৫০-৬০০ টাকা, সোনাদিয়ার রিসকা ৪০০-৫০০ টাকা, সোনাদিয়ার চাপা সুরমা ৭৫০ টাকা, পাকিস্তানি বোয়াল শুঁটকি ৫৫০-৬৫০ টাকা, অলুয়া শুঁটকি ২৫০-৩০০ টাকা, মিয়ানমার থেকে আমদানি হওয়া মইল্ল্যা ৪৫০-৫৫০ টাকা, রাঙ্গাবালির হাঙ্গর ৮০০ টাকা, একই এলাকার লরি হাঙ্গর (বড় হাঙ্গরের মাংস) ৯৫০-১০০০ টাকা, পাত্রা শুঁটকি ৫৫০-৬০০ টাকা, রাঙ্গাবালির চইক্ক্যা কেজি ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও আছদগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে কাসকি, কামিলা, টেংরা, ফলি, তবলা, মাইট্যা, ধনচা ও কেড়াসহ বিভিন্ন শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে শুঁটকিতে কেমিক্যাল ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পুষ্পল দত্ত জানান, শুঁটকিতে ব্যবহৃত ক্ষতিকারক কেমিক্যাল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিডনি নষ্ট, লিভার ডেমেজ ও ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের কারণ হয় এসব কেমিক্যাল।