চাই সমন্বিত উচ্ছেদ পরিকল্পিত পুনর্বাসন

56

ওয়াসিম আহমেদ

ফুটপাত গিলে খাচ্ছে রাস্তার পাশের বহুতল ভবনগুলো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিডিএ’র (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই। সড়ক-ফুটপাত দখল করে হকাররা ব্যবসা করছে আর চাঁদার টাকার ভাগ চলে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে। সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ অভিযান চালালেও শেষ অবধি ফুটপাতকে দখলমুক্ত করা যায়নি। উচ্ছেদে চসিকের প্রশ্নবিদ্ধ সক্ষমতায় জেলা প্রশাসনের সহায়তা ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে পুলিশের সমন্বয়ের দেখা মেলেনি।
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, উচ্ছেদে সুফল পেতে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ও পরিকল্পিত পুনর্বাসন। অন্যথায় বিচ্ছিন্ন উচ্ছেদ কার্যক্রমে সুফল আসবে না, বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে ক্লান্ত করে তুলবে। কারণ ফুটপাত দখল-হকার নিয়ন্ত্রণের পেছনে বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী জড়িত রয়েছে। ফুটপাতে বসা হকারদের কাছ থেকে সাধ্যের মধ্যে তৃপ্তি নিয়ে কেনাকাটা করতে পারেন সমাজের নি¤œশ্রেণির মানুষ। সংখ্যায় সমাজের সবশ্রেণির চেয়ে বেশি তারাই। ফলে হকারদের বেশ চাহিদাও রয়েছে। তাই হয়তো বারবার উচ্ছেদ করেও থামানো যাচ্ছে না। বিপরীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত, কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষেরা অল্প পুঁজি নিয়ে সহজেই হকারি ব্যবসা করতে পারেন। তাই এই জগতে বিশাল একটি অংশের আগ্রহও চরমে। ক্রেতা ও বিক্রেতার চাহিদার ঢেউকে পুঁজি করে সাম্রাজ্য পেতে বসেছে একটি চক্র।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, যুগ যুগ ধরে ফুটপাতের দখলকৃত অংশ বিক্রি হয়। যে একবার দখল করে সে নিয়মিত টাকার বদলে ভাড়া দেয়। না হয় উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার জায়গায় পুত্র বা আত্মীয়-স্বজন বসছে। তবে বাইরের কারো বসার সুযোগ নেই। আরও জানা গেছে, আন্দরকিল্লা থেকে পুরাতন রেলস্টেশন পর্যন্ত ফুটপাত ৬টি হকার সংগঠনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। আমতল থেকে পুরাতন রেলস্টেশন পর্যন্ত ফুটপাত দখলে রয়েছে চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার্স সমিতি, মেট্রোপলিটন হকার্স সমিতি ও চট্টগ্রাম হকার্স লীগ।নির্ধারিত জায়গায় বসলেই গুনতে হয় সংগঠনের নির্ধারিত চাঁদা। আবার ওসব এলাকায় বাতি জ্বালানো, পানি সাপ্লাই ও দৈনিক সুদের ভিত্তিতে টাকা দেওয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন সংগঠনের নেতারা। কেসিদে রোড থেকে লালদিঘী সিটি হকার্স লীগ এবং আন্দরকিল্লা থেকে টেরিবাজার এলাকা আন্দরকিল্লা টেরিবাজার হকার্স সমিতির দখলে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সম্মিলিত হকার্স লীগ নামের একটি সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এসব সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নুরুল আলম লেদু, প্রবীণ কুমার ঘোষ, হারুন রশীদ, আসগর আলী, লোকমান ও হাকিম নামের কয়েকজন।
হকারদের শৃঙ্খলায় ফেরাতে বিফলে যাওয়া চসিকের উদ্যোগ: হকারদের শৃঙ্খলায় ফেরাতে সিটি করপোরেশন বেশ কয়েকবার উদ্যোগী হয়েছে। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন হকারদের তালিকা ও পরিচয়পত্রের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আংশিক তালিকা হলেও পুরো নগরে ছড়িয়ে থাকা হকারদের তালিকা করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। একইসাথে তিনি বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হকার বসার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। করোনাকালে সে সময় কমিয়ে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা করেছেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এসব উদ্যোগ ছাড়াও ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চললেও তা স্থায়ী হয়নি। অর্থাৎ স্থায়ী কোনো সমাধানের পথ উন্মেচিত হয়নি।
স্থায়ী সমাধান কি হতে পারে : হকার সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেন এমন বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তাদের মতে মান্ধাতা আমলের হকার পুনর্বাসন বা হকার মার্কেট করে এ সমস্যা সমাধান করা যাবে না। কেননা দেশের অনেক জায়গায় হকার মার্কেট করা হয়েছে কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। তা ছাড়া হকার অধ্যুষিত এলাকায় মার্কেট করার মত জায়গা বা পরিস্থিতি নেই। তাই হকার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন জাতীয় নীতিমালা। যেখানে হকাররা কিভাবে বসবে এবং কিভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করা হবে। এ আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের বিধান থাকবে। নির্দিষ্ট একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হকারদের নিয়ন্ত্রণ করবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাস বড়ুয়া পূর্বদেশকে বলেন, ফুটপাত নিয়ে লোক দেখানো কাজ ছাড়া কিছু হয়নি। কোনো মেয়রের আমলে হয়নি। আমরা হাঁটার অধিকার চাই ব্যানারে আন্দোলন হয়েছে। আমি, প্রয়াত নজরুল ইসলাম স্যারসহ অনেক জ্ঞানী-গুণি মানুষ সম্পৃক্ত ছিলাম। কিন্তু আমাদের দাবি, সাধারণ মানুষের দাবি-কান্না দায়িত্বশীলদের চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমাদের শহরে যেসব ফুটপাত রয়েছে, তা প্রশস্তের দিক দিয়ে মানসম্মত নয়। ফুটপাতের প্রস্থ মিনিমাম ১ দশমিক ৮৫ মিটার হতে হবে। যাতে অন্তত দুইটি প্রতিবন্ধীর হুইল চেয়ার পাশাপাশি ক্রশ করতে পারে। সিটি করপোরেশন ফুটপাত নির্মাণের সময় তা মানছে না।
উচ্ছেদ বা পুনর্বাসন সমাধান নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা যখন কোনো কথা বলি, তখন বারবার বিদেশের উপামা দিই। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ভাসমান দোকান আছে। তবে তা অবশ্যই শৃঙ্খলিত উপায়ে পরিচালিত হয়। সেখানে কেউ ফুটপাত দখল করে ভবন করে না। আমাদের রাস্তার পাশে অধিকাংশ ভবন নির্মাণে ফুটপাত-রাস্তা দখল করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ভূমিকা কি? তারা চুপ থাকছে বিধায় এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা হচ্ছে। এখানে শুধু সিটি করপোরেশন মরিয়া হলে হবে না, প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। অন্যদিকে হকারদের ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে ফুটপাতে পথচারীদের হাঁটার জায়গা রেখে ব্যবস্থা করা যায়। যদি ফুটপাত আকারে বড় হয় সেক্ষেত্রে নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে যুক্ত করতে হবে। অন্যথায় ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ টেকসই হবে না।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ফুটপাত দখলদারদের উচ্ছেদে কার্যক্রম চলছে। নিউ মার্কেট এলাকায় সবেচেয়ে বেশি ফুটপাত বেদখলে। নগরীর অন্য জায়গায় ফুটপাত উচ্ছেদের মাধ্যমে তাদেরও বার্তা দিতে চাই, ফুটপাত তাদেরও ছাড়তে হবে। তবে এর আগে তাদের শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করবো। তা যদি না হয় উচ্ছেদ করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, ফুটপাত বানানো হয় মানুষ হাঁটার জন্য। আমরা টাইলস লাগিয়ে প্রতিবন্ধী চলাচল উপযোগী ফুটপাত নির্মাণ করছি। দোকান বসিয়ে ব্যবসা করার জন্য নয়। হকাররা ফুটপাতে বসে ভাসমানভাবে ব্যবসা করে। দখল করে তা প্রভাবশালীরা। সোজা কথা যে যত প্রভাবশালী হোক না কেন ফুটপাত ছাড়তে হবে। পানি চলাচলের নালা দখল করলেও ছাড়তে হবে। পরিচ্ছন্ন বিভাগকে অফিসিয়ালি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সেভাবে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তিনি আরও বলেন, হকারদের পুনর্বাসন করলে ফুটপাত দখলমুক্ত হয়ে যাবে না। আগেও হয়নি। ৭২ সাল থেকে নগরে দেখছি, হকার মার্কেট হয়েছে কিন্তু হকারমুক্ত কি হয়েছে? হয়নি। তাই যেসব ফুটপাতের পাশে সিটি করপোরেশনের জায়গা রয়েছে সেখানে হকারদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। বায়েজিদ-শেরশাহ এলাকায় করা হচ্ছে। আগ্রাবাদে ফুটপাত থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। সেখানে ফুটপাতের পাশে খালি জায়গা তাদের ব্যবসা করতে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান। তবে কোনোভাবে ফুটপাত -সড়কে সহ্য করা হবে। হকারদের সামনে রেখে অনেক প্রভাবশালী ফুটপাত দখলে সাথে যুক্ত বলে মন্তব্য করেন সিটি মেয়র।