চসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সগৌরবে ফিরে আসুক

16

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যে দুটি বিভাগ নিয়ে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদায় অভিষিক্ত-এর একটি শিক্ষা বিভাগ অপরটি স্বাস্থ্য বিভাগ। সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব কার্যক্রমের বাইরে এ দুটি বিভাগের লালন-পালন, সম্প্রসারণ ও অর্জন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে বিশ্ব দরবারে আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯২৭ সালে তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান নুর আহমদ (প্রকাশ নুর আহমদ চেয়ারম্যান) চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারে পৌরসভার তত্ত¡াবধানে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেন। নুর আহমদ চেয়ারম্যানের এ যুগান্তকারী পদক্ষেপ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এবং পরবর্তী পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রশংসা লাভ করে। নুর আহমদ চেয়ারম্যানের পরবর্তী যারাই চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান কিংবা প্রশাসক বা মেয়র নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, প্রত্যেকেই এ শিক্ষা বিভাগকে স্বযতেœ লালন করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ এবং মানোন্নয়ন করেছেন চট্টল বীর হিসেবে খ্যাত মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রায় পঞ্চাশের অধিক প্রাইমারি, কিন্ডারগার্টেন, সাংস্কৃতিক টোল, বয়স্ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ (ডিগ্রি)সহ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ৪১০টি মসজিদ ভিত্তিক ফোরকানিয়া মাদ্রাসা তিনি চালু করেন। শুধু তাই নয়, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিসকে তিনি বাধ্যতামূলক করেছিলেন। নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়ে তিনি বেশ সচেতন ছিলেন। শিক্ষা বিভাগে কমপক্ষে তিনজন শিক্ষা কর্মকর্তা সবসময় নিয়োগ দিতেন, তারা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ও নগরীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষাবিদদের নিয়ে তিনি উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করেন এবং নির্বাচিত কাউন্সিলরদের নিয়ে গঠিত শিক্ষা স্ট্যান্ডিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকি করতেন। এসময় আমরা দেখেছি চসিক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি মাধ্যমিক ও কলেজের পাশাপাশি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল। শিক্ষা বোর্ডের সেরা বিশে চসিকের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থান করে নিত। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরীর চসিক মেয়র থেকে বিদায়ের পর কর্তৃপক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার চেষ্টা করলেও বাস্তবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নেয় নি। নানা কারণে চসিকের এ বিভাগ এখন শ্বেতহস্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। একমসয়ের জ্যোতিছড়ানো বিভাগটি এখন প্রায় ¤্রয়িমান। জানা যায়, এ ভিাগের অধিনে এখন প্রায় ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু সেই অনুপাতে স্থায়ী শিক্ষক কর্মচারি নেই। ২৩ টি কলেজের ১৯টিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, প্রায় ৩৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক নেই। ২০০৯ সাল থেকে কয়েকশত শিক্ষক অস্থায়ী হিসেবে নির্ধারিত বেতনে চাকরি করে আসলেও তাদের স্থায়ীকরণের ওয়াদা ও স্বপ্ন তিমিরেই। অনেক শিক্ষক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়া চসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদারকি এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক কার্যক্রমও অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। আমাদের কাছে এমন তথ্যও আছে, কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি, সিনিয়রটি, সরকারের নির্ধারিত প্রাপ্য বেতন গ্রেড থেকে অতিরিক্ত গ্রেডের বেতন উত্তোলন এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও তা সমাধানে সঠিক কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়না। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ছত্রছায়ায় শিক্ষকের বিনা ছুটিতে দেশের বাইরে অবস্থান, দিনের পর দিন অনুপস্থিত থেকেও বেতন উত্তোলনের মত গুরুতর অভিযোগও পাওয়া যায়। অতিসম্প্রতি চসিক পরিচালিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, প্রধান শিক্ষককে লাঞ্চিত করার ঘটনা নগরবাসীকে লজ্জায় ফেলেছে। এ ঘটনা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে যেমন বিব্রত করেছে তেমনি শিক্ষক সমাজের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ঘটনার খবর সংবাদপত্রগুলোতে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাতে সহজে অনুধাবন করা যায়, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের সাথে নানা রকম নিপীড়নের অভিযোগ নতুন নয়, এটি পুরনো অভিযোগ। যা ২০১৩ সাল থেকে হয়ে আসছে। এরজন্য তাকে শাস্তিও পেতে হয়েছে। এরপর ২০১৯ সালে তিনি ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আমাদের কথা হচ্ছে, ঘটনা যদি সত্যিই হয়, তবে একই অভিযোগের জন্য অতীতে শাস্তি পাওয়া লোক এতোদিন কিভাবে চসিকের মত একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে চাকরি করেন। এর দায় অবশ্যই চসিককে বহন করতে হবে। এ ঘটনা কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টির ভাবমুর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নগরীর নামকরা এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি যদি কর্তৃপক্ষ আরো বেশি আন্তরিক হতেন, তবে এধরনের প্রতিষ্ঠান প্রধানকে আরো আগে বিদায় করা প্রয়োজন ছিল। এখন যা হয়েছে বা হচ্ছে, তা পানি ঘোলা করে খাওয়ার নামান্তর। বর্তমান মেয়র একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাশাপাশি তিনি একজন লেখক ও সৃজনশীল মানুষ। তিনি শুরুতে চসিকের শিক্ষা বিভাগকে স্বগৌরবে ফিরে আনার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। আমরা জানি, প্রতিশ্রæতি রক্ষায় তাঁর আন্তরিকতার কোন ঘাটতি না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির আমলাতান্ত্রিকতা যেকোন সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি। আমরা আশা করি, তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে চসিককে সমহিমায় গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। শিক্ষা বিভাগেও স্বগৌরবে ফিরে আনবেন।