চসিকের তদন্ত উদ্যোগে সিডিএ-এর সাধুবাদ

30

এম এ হোসাইন

ফাটল দেখা দেয়ার অভিযোগ উঠায় বন্ধ করে দেওয়া বহদ্দারহাট এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের র‌্যাম্প ৪ দিনেও খুলেনি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একটি তদন্ত টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করে এটিকে ‘ফাটল নয়’ বলে দাবি করেছে। বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) আলাদাভাবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সমন্বয়ে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই সংস্থার তদন্ত শেষে র‌্যাম্প খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসবে। যদিও সিডিএ র‌্যাম্প খুলে দেয়ার বিষয়টি চসিকের একক সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, এখন র‌্যাম্প খুলে দেওয়া বা না দেওয়া পুরোটা সিটি কর্পোরেশনের বিষয়। সিটি কর্পোরেশন আমাদের কাছ থেকে সাহায্য চাইলে আমরা সাহায্য করবো। ব্যারিয়ার করে দিতে বললে আমরা করে দিব। ক্রস ডিভাইডার করে দিতে বললে করে দিব। যেহেতু আমরা সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করেছি, তারা সিদ্ধান্ত নিবে কি করবে। আমাদের কোনো সহযোগিতা চাইলে, সার্পোট চাইলে আমরা শুধু সে সহযোগিতা করবো।
তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ হচ্ছে ব্যারিয়ার দিতে হবে। সিটি কর্পোরেশন আরেকটা তদন্ত কমিটি করেছে। আমরা সেটাকে সাধুবাদ জানাই। যত তদন্ত হবে তত নিশ্চিত হওয়া যাবে। আলাদা আলাদা তদন্ত হলে মানুষের আস্থাও বাড়বে। আমরা যখন র‌্যাম্পটি চালু করেছিলাম তখন কিন্তু ব্যারিয়ার দিয়েছিলাম। পরে সিটি কর্পোরেশনকে হ্যান্ডওভার করার পর রাস্তার কাজ করতে গিয়ে তারা ব্যারিয়ারটি ভেঙে ফেলে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সিডিএ’র বোর্ডসভায় ফ্লাইওভারের পিলারের ফাটলের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে এবং পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর করণীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে কথা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ বোর্ড সদস্য কেবিএম শাহজাহান বলেন, ফ্লাইওভারে ফাটলের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর তদন্ত শেষ হলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা হয়েছে। বোর্ড সভার আলোচনা অন্যান্য এজেন্ডার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
র‌্যাম্পটির নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ডিজাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (ডিপিএম) কনসালটেন্ট লিমিটেড এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের বিশেষজ্ঞরা বুধবার সরেজমিনে পরিদর্শন করে ‘ফাটল পাওয়া যায়নি’ বলে জানান। তবে অধিকতর নিশ্চিত হতে কারিগরি পরীক্ষা করবে দলটি। প্রয়োজনে ক্র্যাক হওয়া স্থানটি কেটে পিলারে ভেতরে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা তাও দেখা হবে। ‘আন ফিনিশিং জয়েন্ট’ এর কারণে ফাটলের মতো দেখাচ্ছে। হাল্কা যান চলাচলের জন্য ফ্লাইওভার এখনি খুলে দেওয়া যেতে পারে এমন মত দিয়েছেন তাঁরা।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন প্ল্যানিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট (ডিপিএম) এর ডিরেক্টর মো. শাহজাহান বলেন, বাইরের দেখে দেখতে ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পের পিলারে ফাটলের মত যেটি দেখা যাচ্ছে সেটি ফাটল নয়। এটি মূলত ‘আন ফিনিসিং জয়েন্ট’। পিলার নির্মাণের সময় ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়। একটি ধাপের কাজ শেষ করে অপর একটি ধাপের সংযোগ স্থলে কিছুটা কংক্রিট ও প্লাস্টার বের হয়ে আছে। যা দেখতে ফাটলের মতো দেখাচ্ছে।
সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী ও ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, বিশেষজ্ঞ দল পরিদর্শনে পিলারে কোনো ফাটল পায়নি। তাই ২ দিনের মধ্যে ফ্লাইওভার খুলে দেওয়া হবে।
তবে র‌্যাম্পটি খুলে দেয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সংস্থা থেকে সিদ্ধান্ত আসেনি। ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করার পদক্ষেপ হিসাবে ব্যারিয়ার তৈরি এবং মূল ফ্লাইওভারের ক্রস ডিভাইডার বন্ধ করে দিয়ে র‌্যাম্পটি খুলে দেয়ায় মত রয়েছে প্রকৌশলীদের। তদন্ত কমিটিগুলোর প্রতিবেদনের পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে পারে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, যারা কনসালটেন্ট তারা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ। তারা একই ধরনের অনেক কাজ করেছেন। যার কারণে তাদের দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। একাধিক সংস্থা তদন্ত করলে সেটা আরো ভালো, এতে মানুষের আস্থাও বাড়বে।
গত ২৫ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে পিলারে ফাটল মনে করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ আরাকান সড়কমুখী র‌্যাম্পে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরদিন পরিদর্শনে গিয়ে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী নির্মাণ ত্রুটির কারণে এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ওইদিন বিকেল পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমানও বলেন, ভারী যানবাহন চলাচল অথবা নির্মাণকাজে ভুল থাকার কারণে পিলারে ফাটল হতে পারে। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি আবার দাবি করেন, যেটিকে ফাটল বলে আলোচনা করা হচ্ছে বাস্তবে সেটা ফাটল নয়, এটি ‘ফলস কাস্টিং’।
ফাটল না হলে কেন র‌্যাম্পটি খুলে দেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। র‌্যাম্পটি বন্ধ থাকায় আতঙ্ক বাড়ছে বহদ্দারহাট এলাকায়। ‘ফাটল’ দেখার জন্য অনেক মানুষ অতিউৎসাহী হয়ে যেমন আসছেন তেমনি র‌্যাম্পের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় দ্রুত স্থান ত্যাগ করছেন আতঙ্কিতরা।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের মার্চে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মীর আক্তার-পারিশা (জেভি) কনস্ট্রাকশন। মীর আকতার প্রধান অংশীদার হলেও মূল কাজ করে পারিশা। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করার সময় ২০১২ সালের ২৯ জুন একটি গার্ডার হঠাৎ ধসে পড়ে। এতে একজন রিকশাচালক সামান্য আহত হন। এরপর একই বছরের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসের ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন নিহত হন। এ ঘটনার পর সিডিএ’র প্রকল্প পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী এ এম হাবিবুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তাঁকে মামলার আসামি করা হয়। প্রথমে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৯১ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ১০৬ কোটি টাকা করা হয়। ফের সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় ১২০ কোটি টাকা করা হয়। ১ হাজার ৩৩২ মিটার দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভারটির প্রস্থ ১৪ মিটার। চার লেনের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের দুই পিলারের দূরত্ব ১৩০ ফিট। শুরু থেকে ফ্লাইওভারটির প্রতি মানুষের অনিহা দেখা গেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে আতঙ্ক তৈরি হয়। সে আতঙ্ক কাটিয়ে যানবাহন ফ্লাইওভারমুখি হতে শুরুর পর নতুন করে পিলারে ফাটল নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। পিলার ফাটল আতঙ্ক থেকে সরে আসতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।