চলছে আলোচনা, চলছে যুদ্ধও

7

পূর্বদেশ ডেস্ক

তুমুল যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনের রাস্তায়। জয়-পরাজয়, লাভ-লোকসান নিয়ে দাবি-পালটা দাবি চলছেই। যুদ্ধের এমন আবহে শান্তি চেয়ে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পঞ্চম দিনে খুলল আলোচনার রাস্তা। গতকাল সোমবার যুদ্ধ বিরতির লক্ষ্যে বেলারুশে তাদের প্রথম দফা আলোচনা শেষ করেছে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের প্রতিনিধিদল।
দ্বিতীয় দফা বৈঠকের আগে দুই দেশের কর্মকর্তারা শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে পরামর্শের জন্য নিজ নিজ রাজধানীতে ফিরে যাচ্ছেন বলে বেলারুশের সংবাদ সংস্থা বেলটাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এ বৈঠক থেকে বড় কোনো অর্জনের আশা কোনো পক্ষেরই তেমন ছিল না। ইউক্রেন দাবি করেছে এখনই যুদ্ধ বন্ধ করে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যদিকে ক্রেমলিন বলেছে এমন সমাধান হতে হবে যাতে দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা হয়।
এর আগে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের এই শান্তি বৈঠক স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় শুরু হয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া আর এক প্রজাতন্ত্র বেলারুশের প্রধান প্রশাসনিক অঞ্চল হোমেলে। আলোচনার টেবিলে বসে যুদ্ধ থামে কিনা, সেটাই এখন দেখার।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বলা হয়েছে তারা এই মুহূর্তে যুদ্ধ বিরতি এবং রুশ সৈন্য প্রত্যাহার চায়। শান্তি বৈঠকে রুশ প্রতিনিধিদলের প্রধান প্রেসিডেন্ট পুতিনের উপদেষ্টা ভ্লাদিমির মেদিনস্কি বলছেন মস্কো এমন একটি বোঝাপড়া চায় যা দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করবে।
তবে আলোচনার মাঝেও ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা সক্রিয়তায় কোনও ফারাক পড়েনি। ইউক্রেনের রাজধানীর দখল নিতে নতুন করে সেনা পাঠাচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেনের রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে রাশিয়ার পদাতিক সৈন্যের বড় একটি বহর। এক দিকে যখন ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার আলোচনা চলছে, ঠিক তখনই কিভের পথে মস্কোর পাঠানো নতুন বাহিনীর ছবি ধরা পড়ল আমেরিকার কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবিতে। সোমবার সকালে প্রকাশ্যে এসেছে ছবিটি। আমেরিকার ওই উপগ্রহচিত্রে নজর রাখছিল যে সংস্থাটি তারাই কিভের পথে চিহ্নিত করেছে রুশ সাঁজোয়া বাহিনীকে। প্রায় পাঁচ কিমি দীর্ঘ সেই সাঁজোয়া বাহিনী শেষ প্রকাশিত ছবি অনুযায়ী ছিল কিভ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ছিল। অন্যদিকে সূত্রে দাবি করা হয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সহযোগী চেচেন যোদ্ধারাও এগোচ্ছে কিভের দিকে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে রাশিয়ার আগ্রাসন ও সামরিক অভিযানের মুখে ইউক্রেইন থেকে পালিয়ে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়েছে গেছে। এক টুইটে সংস্থাটি জানিয়েছে, ইউএনএইচসিআর পালিয়ে যাওয়া এইসব মানুষদেরকে প্রয়োজনমত সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং অংশীদারদের সঙ্গে মিলে কাজ করে যাচ্ছে।
বৈঠক শুরুর আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রুশ সৈন্যদের অস্ত্র নামিয়ে রাখার আহব্বান জানিয়েছেন। একইসাথে তিনি ইউক্রেনকে দ্রুত সদস্যপদ দেওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি অনুরোধ করেছেন।
এক ভিডিও ভাষণে ৪৪ বছর বয়সী এই নেতা আহব্বান জানান, নতুন বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখনই ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত করে নিতে আমরা আবেদন জানাচ্ছি।’ বার্তা সংস্থা এএফপি খবরে এ তথ্য জানানো হয়। রাশিয়ান সেনাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করার আহব্বান জানিয়ে জেলেনস্কি বলেন, আপনারা অস্ত্র ফেলে দিয়ে এখান থেকে বিদায় নিন। আপনাদের কমান্ডার ও প্রোপাগান্ডা ছাড়ানোকারীদের বিশ্বাস করবেন না। নিজের জীবন বাঁচান।’
ইউক্রেনের নেতা আরও জানান, দেশে যেসব বন্দী, যাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারা দেশকে রক্ষায় সাহায্য করতে পারবেন। জেলেনস্কি বলেন, নৈতিক স্থান থেকে আমাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি দরকার।
যুদ্ধের টানা পঞ্চম দিনে গতকাল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভে রাশিয়ার ভারী গোলাবর্ষণে কয়েক ডজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং শত শত আহত হয়েছেন বলে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কিয়েভের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা অ্যান্টন হেরাশচেঙ্কো ফেসবুকে লিখেছেন, মস্কোর সেনারা আবাসিক এলাকায় গ্রাড ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বোমা বর্ষণ করেছে। এতে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছেন এবং শত শত আহত হয়েছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ঠিক কতজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন তা এখন বলা সম্ভব নয়। তবে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান বলেন, কমপক্ষে ১০২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং আরও ৩০৪ জন আহত হয়েছেন।
কিয়েভের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, যুদ্ধের প্রথম চার দিনের সংঘর্ষে রাশিয়ার পাঁচ হাজারের বেশি সেনা নিহত হয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইউক্রেন বাহিনীর হাতে আনুমানিক পাঁচ হাজার ৩০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার ১৯১টি ট্যাংক, ২৯টি যুদ্ধ বিমান, ২৯টি হেলিকপ্টার এবং ৮১৬টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ধারণা করছে, রাশিয়ার ভারী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে সংঘাতে তাদের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ঠিক কতজন হতাহত হয়েছে এর সংখ্যা জানায়নি দেশটি।
অপরদিকে ইউক্রেনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জাপোরিজ্জায়ার পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও বর্তমানে রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিয়েছে রুশ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্স।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দখলে নিলেও ধংস করেনি রুশ বাহিনী। জাপোরিজ্জায়ার দুই শহর বারদিয়ানস্ক ও এনারহোডারের দখল নিয়েছে রুশ সেনাবাহিনী।
আবার এই তথ্যের সত্যতা অস্বীকার করেছে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা বলছে এই খবর সত্য নয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনও ইউক্রেন সরকারের দখলেই আছে।
এদিকে রাশিয়ার হামলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেন। রোববার ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবার এক টুইটের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কাছে হোস্তোমিল বিমানবন্দরে লড়াই চলাকালে আন্তোনভ এএন-২২৫ মডেলের উড়োজাহাজটি ধ্বংস করা হয় বলে উল্লেখ করেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
টুইটে দিমিত্রি কুলেবা বলেন, এটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ এএন-২২৫ ‘ম্রিয়া’ (ইউক্রেনীয় ভাষায় এর অর্থ স্বপ্ন)। রাশিয়া হয়তো আমাদের স্বপ্ন ধ্বংস করেছে। তবে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের স্বপ্নকে তারা কখনো ধ্বংস করতে পারবে না।
আন্তোনভ এএন-২২৫ উড়োজাহাজ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে নকশা ও নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মাণের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশযান বহন করা। তবে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে উড়োজাহাজটি এ কাজে ব্যবহার করা হয়নি।