চমেকে খুলছে পোড়া রোগীদের আধুনিক চিকিৎসার দ্বার

20

এম এ হোসাইন

কলকারখানা, শিল্প-প্রতিষ্ঠান আর ব্যবসায়িক শহর হিসাবে প্রচুর কর্মী কাজ করছেন চট্টগ্রামে। প্রতিনিয়ত ব্যাপক পরিসরে বাণিজ্যিক কাজ পরিচালিত হচ্ছে এখানে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়তই ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। আগুন, গ্যাস বিস্ফোরণসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ। অথচ চট্টগ্রামে এখনও পর্যন্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিট নেই। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি অগ্নিকান্ড নতুন করে বার্ন ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে চীন সরকারের ১৫০ শয্যার বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট উপহার পেতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। আগামীকাল সোমবার বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে। দুই বছরের মধ্যে দেড়শ শয্যার পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সজ্জিত করা হবে। ৬ তলা ভবনের প্রতি ফ্লোরে স্পেস থাকবে ১৬ হাজার বর্গফুট। জরুরি বিভাগের পাশাপাশি থাকবে বহির্বিভাগ। ইউনিটটিতে ২টি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০টি নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) শয্যা এবং ২৫টি উচ্চ নির্ভরশীল ইউনিট (এইচডিইউ) শয্যা থাকবে। এক একর জায়গার উপর এই ইউনিটনিট স্থাপন করা হবে। চীন সরকারের অর্থায়নে ইউনিটটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও এটি পরিচালনা করবে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন, চট্টগ্রামে একটা বার্ন ইউনিট হবে। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া একটি করুণ মৃত্যু। ক্যান্সারের রোগী আস্তে আস্তে মারা যায়, হার্টের রোগী হঠাৎ করে মারা যায়। সেটা বুঝা যায় এবং চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু একজন আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীর জন্য প্রথম ২৪ ঘন্টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ে যাওয়া জটিল রোগীদের ঢাকায় প্রেরণ করা হতো। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রোগী মারা যায়। কিন্তু এখন চট্টগ্রামে চিকিৎসা হবে। আগুনে পুড়ে মৃত্যুর সংখ্যাটা কমিয়ে আনতে পারবো।
তিনি বলেন, ইউনিটটিতে ২টি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০টি নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) শয্যা এবং ২৫টি উচ্চ নির্ভরশীল ইউনিট (এইচডিইউ) শয্যা থাকবে। চীনা সরকার হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণ করবে এবং পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য সব আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে। ইউনিটটি চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করবে।

বার্ন ইউনিটের উদ্যোগ যেভাবে : চমেক হাসপাতালে চীনের অর্থায়নে একটি বার্ন হাসপাতাল নির্মাণ করতে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। চীনা সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্প স্থানও পরিদর্শন করা হয় কয়েকবার। ২০১৬ সালে চমেক হাসপাতাল এলাকায় সম্ভাব্য জায়গা পরিদর্শন করে চীন সরকারের একটি প্রতিনিধি দল। পরিদর্শনে তারা হাসপাতালের বর্তমান বার্ন ইউনিটের পেছনের খালি জায়গায় বিশেষায়িত এ ইউনিট নির্মাণ করার কথা জানালে তখন সম্মতি দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশে অবস্থিত চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়ে সম্মতির কথা জানানো হয়। পরে হাসপাতালের নকশাও তৈরি করেন তারা। কিন্তু দ্বিতীয়বার এসে পরিমাপ করে জায়গা কম পাওয়ায় এ নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়। সর্বশেষ চলতি মাসে দুইবার চীনা প্রতিনিধি দল বার্ন হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত গোয়াছি বাগানের জায়গাটি পরিদর্শন করে। জায়গাটি পছন্দ হওয়াতে সেখানে স্থাপনা করতে সম্মত হয় দলটি। গতকাল শনিবারও চীনা প্রতিনিধি দল উক্ত এলাকাটি পরিদর্শন করে। এ সময় তারা ভবনের নকশার সব পরিমাপ এবং অন্যান্য দিকগুলো খতিয়ে দেখেছেন। তারা চমেক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। পরে চমেক হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে বৈঠকের কার্যবিবরণী স্বাক্ষরিত হয়। তখন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান এবং বাংলাদেশে চীন দূতাবাসের সেক্রেটারি শি চেন উপস্থিত ছিলেন।
এসময় চীন দূতাবাসের সেক্রেটারি শি চেন বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চুক্তি স্বাক্ষরের ২২ মাসের মধ্যে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে। হাসপাতালটিতে রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকবে এবং এটি হবে একটি আধুনিক হাসপাতাল।

আগামীকাল চুক্তি স্বাক্ষর : চমেকের বার্ন ইউনিট নিয়ে আজ ঢাকায় চায়নিজ অ্যাম্বাসির প্রতিনিধিদের সাথে মিটিং রয়েছে। তাছাড়া আগামীকাল সোমবার এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। চুক্তি সম্পন্ন হলে চট্টগ্রামে দ্রুত সময়ের মধ্যে বার্ন ইউনিটের নির্মাণ শুরু করা হবে।
বার্ন চিকিৎসা সম্প্রসারণে সমন্বয়কের দায়িত্ব পাওয়া ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, চট্টগ্রামে বার্ন হাসপাতাল করার জন্য ১০ বছর ধরে যুদ্ধে করে যাচ্ছি আমি। এটি হবে একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল। আমরা এ বিষয়ে রবিবার (আজ) চায়নিজ অ্যাম্বাসি ও প্রতিনিধির সঙ্গে মিটিং করবো। সোমবার এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামে আগুনে পোড়া রোগীরা উন্নত সেবা পাবেন।

কেমন হবে বার্ন ইউনিট : চমেক হাসপাতালের পেছনে গোয়াছি বাগানে প্রায় এক একর জায়গার উপর নির্মাণ হবে বার্ন ইউনিটটি। ৬ তলার ভবনে হবে পুরো ইউনিটটি। ১৫০ শয্যার ইউনিটটিতে রোগী আনা নেওয়ার সুবিধার জন্য তিনটি রাস্তা তৈরি করা হবে। চট্টেশ্বেরী রোডের দিকে হবে বার্ন ইউনিটের প্রধান রাস্তা। তাছাড়া চমেক ছাত্র হোস্টেলের দিকে একটি এবং মিজান হোস্টেলের দিকে আরেকটি রাস্তা তৈরি করা হবে। সে রাস্তাটি ওয়ার সিমেট্রির পাশ হয়ে বের হয়ে যাবে।

কি কি থাকবে ইউনিটে : ছয় তলা ভবনের ইউনিটটির প্রথম তলায় থাকবে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড এবং ওটি, দ্বিতীয় তলায় ৩টি ওটি (অপারেশন থিয়েটার এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), তৃতীয় তলায় পুরোটা হাই ডিপেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), ৪র্থ এবং ৫ম ওর্য়াড, ৬ষ্ট তলায় ওয়ার্ড এবং অফিস থাকবে।

সরেনি স্থাপনা : গোয়াছি বাগানের যে স্থানে বার্ন ইউনিট স্থাপনের কাজ করার কথা সেখানে শতাধিক স্থাপনা রয়েছে। এসব স্থাপনা সরাতে ইতিমধ্যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের ২০ তারিখের মধ্যে জায়গা খালি করে দিতে বলা হয়েছে। এরপরও না সরলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গটি নিয়ে চমেক পরিচালক বলেন, শতাধিক স্থাপনা রয়েছে। চীনা প্রতিনিধিরা দ্রæত কাজ শুরু করতে চান। যখন জায়গা খালি হবে তখনই কাজ শুরু করবেন তারা। আমরা ২০ তারিখের মধ্যে সরে যেতে নোটিশ প্রদান করেছি। না সরলে সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। যা করার জেলা প্রশাসন থেকে করবে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামসহ আশপাশের জেলার অন্তত চার কোটি মানুষের একমাত্র ভরসা চমেক হাসপাতালের ২৬ শয্যার বার্ন ইউনিট। হাসপাতালের ৩৬ নম্বর এই ওয়ার্ডটিতে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগী ভর্তি থাকে। এর মধ্যে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া তুলনামূলক খারাপ রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার বার্ন হাসপাতালে। আইসিইউ এবং অপারেশন থিয়েটার না থাকায় এমনিতেই সংকটাপন্ন রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়। এতে করে রোগীর স্বজনের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে অনেক সময় চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়।