চবি একাউন্টিং বিভাগের ৫০ বছর

6

ড. কাজী আহমদ নবী

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর প্রফেসর আলী ইমদাদ খান স্যারের হাত ধরে ১৯৭১ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় একাউন্টিং বিভাগ। চলতি বছরে এই মাসেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাউন্টিং বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব যা আমাদের জন্যে খুবই আনন্দের। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশকে বহু শিক্ষিত, মেধাবী ও তরুণ জনশক্তি উপহার দিয়েছে বিভাগটি।
সৌভাগ্যক্রমে আমি একাউন্টিং বিভাগের প্রথম ব্যাচের (১৯৭০-১৯৭১) ছাত্র ছিলাম। তৎকালীন সময়ে আমাদের এই বিভাগটি কলা অনুষদের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হতো। আমরা আমাদের এই বিভাগটিকে নিয়ে স্বতন্ত্র একটি অনুষদ (বাণিজ্য অনুষদ যা বর্তমানে ব্যাবসায় প্রশাসন অনুষদ) করার কথা চিন্তা করলাম। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমার সভাপতিত্বে দুজনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড. এ আর মল্লিক স্যার তখন ভিসি ছিলেন। অবশেষে আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সফল হলাম এবং “বাণিজ্য অনুষদ” নামে বর্তমান ব্যাবসায় প্রশাসন অনুষদের যাত্রা শুরু হয়।
উল্লেখ্য যে, আমার মাস্টার্সের পরীক্ষা পাকিস্তান আমলে হয়েছে। যতটুকু মনে পরে, ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যেদিন স্বাধীনতার ডাক দিলেন সেদিন আমাদের শেষ পরীক্ষাটা সম্পন্ন হয়েছিল। মজার বিষয় হলো পরীক্ষাটা পাকিস্তান আমলে হলেও আমাদের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ আমলে। আমি মাস্টার্সে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলাম। একাউন্টিং বিভাগে যে সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাদের আলোকিত করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অধ্যাপক আলী ইমদাদ খান, অধ্যাপক সৈয়দ সামসুজ্জোহা, অধ্যাপক ডঃ আব্দুল হাই এবং অধ্যাপক অমল ভূষণ নাগ সহ আনেকেই।
১৯৭৩ সনের ১৮ই এপ্রিল আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি। পরবর্তীতে আমি শিক্ষকতার সাথে নানা দায়িত্ব যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট, গবেষণা সেলের প্রধান, বিভাগীয় সভাপতি, শিক্ষক সমিতির ট্রেজারার, ফাইন্যান্স কমিটির সদস্য, সিনেট সদস্য, একাডেমিক কাউন্সিল সদস্য, উচ্চতর পড়াশোনা বোর্ডের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত নানা কমিটির প্রধান হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করি। এ ছাড়াও আলাওল হলের খেলার মাঠ ও গেস্ট রুমের ব্যাবস্থা করা, গবেষণার সুবিধার্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বদেশে বিদেশে সম্পাদিত এম ফিল পিএইচ ডি এর সারসংক্ষেপ নিয়ে ৪০০ পৃষ্ঠার সম্পাদিত বই, চাকসু ভবনে সেলফ সার্ভিস ক্যান্টিন চালু করে একাউন্টিং বিভাগের পড়াশোনাকে উচ্চতর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের প্রথম দিনের একটি স্মরণীয় ঘটনা আজও মনে পরে। সে দিন খান স্যার ছুটিতে থাকায় নাগ স্যার আমাকে এম কম ফাইনাল ইয়ারে ম্যানেজমেন্ট একাউন্টিং ক্লাসটি নিতে বললেন। আমি নতুন হিসাবে আমার মধ্যে কোনো ভয়ভীতি কাজ করে নি। আমি ক্লাসটি ভালোভাবে নিয়েছিলাম। উক্ত ক্লাসে অনেকের সাথে আবুল হাশেমও ছিল যিনি পরে ড. আবুল হাশেম হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিং এর প্রফেসর, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য হয়েছিলেন।
প্রভাষক হিসেবে আমার মাসিক বেতন ছিল ৪৫০ টাকা। কিন্তু মাস্টার্সে যেহেতু আমার ফার্স্ট ক্লাস ছিল সেহেতু ৫০ টাকা ইনক্রিমেন্ট দিয়ে ৫০০ টাকা বেতনে আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু করি। তখন আমাদের শিক্ষকদের জন্য বসার আলাদা কোন রুম ছিল না। আমরা সকল শিক্ষক এক রুমে বসতাম। পরবর্তীতে আলাদা রুম দিলেও সেটা ছিল গ্যালারীর উপরে টিনের ছাউনি দেয়া ছোট ছোট রুম। অতিরিক্ত গরম আর কাকের পায়ের শব্দে সেখানে অবস্থান ও পড়াশোনা করাটা কষ্টসাধ্য ছিল। আমাদের বিভাগে ট্রেইন্ড শিক্ষকের সংখ্যা কম ছিল। এ ছাড়াও কর্মচারীর সংখ্যাটাও তুলনামূলকভাবে কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে সিনিয়র প্রফেসরের মাসিক বেতন লাখের উপরে। সকল সিনিয়র শিক্ষকদের আলাদা আলাদা অফিস কক্ষ রয়েছে। ট্রেইন্ড শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশি। যেমন বর্তমানে একাউন্টিং বিভাগে ১০ জন অধ্যাপক, ০৬ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ০৭ জন কর্মচারী রয়েছেন। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ০২টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে মোট ০৬টি বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণা খাতে ব্যাপক আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করছে, যার পরিমাণ আমাদের সময় ছিল খুবই নগণ্য। তাই আমি মনে করি একাউন্টিং বিভাগের যে সকল শিক্ষক গবেষণায় নিয়োজিত আছেন তাদের পাশাপাশি অন্যদেরও। এই সুযোগ নিয়ে কষ্ট করে সকল প্রক্রিয়া সময় মতো সম্পাদন করা উচিত যা ভবিষ্যতের গবেষণাকে সহজলভ্য করবে এবং বিভাগীয় সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
একাউন্টিং বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যানের সাথে আলাপ প্রসংগে তিনি জানান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত ১:৪০ কিন্তু বর্তমানে আমাদের একাউন্টিং বিভাগে এই অনুপাত হচ্ছে ১:১২০। এতে ছাত্র ছাত্রীদের ঘনিষ্ঠভাবে যতœ নেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আমি মনে করি শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো জরুরি।
কোভিডের কারণে বর্তমানে বিভাগটির কার্যক্রম ১ বছর পিছিয়ে আছে। কিন্তু বিভাগীয় সভাপতি ড. আইয়ুব ইসলাম আশা করছেন শীঘ্রই এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। অনুষদের সম্মানিত ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী সাহেবও এই সমস্যা সমাধানে সার্বিক সহযোগিতা করছেন। আমি মনে করি এই সমস্যা সমাধানে অনলাইন ক্লাসও একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
একাউন্টিং বিভাগ তথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে দীর্ঘ ৪২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অনেক কিছুই দিয়েছে। যেমন- আমি ভারতের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচ ডি করেছি, ব্রিটেনের ষ্টার্লিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ব্রিটিশ কাউন্সিল ফেলোশিপ”, জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “হোমবোল্ডট ফেলোশিপ”, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় এট আর্বানা সেম্পেইন থেকে “ফুল ব্রাইট সিনিয়র ফেলোশিপ”, জাপানের ইওকোহামা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে “জাপান ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ” নিয়ে চারবার পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেছি। এ সবের জন্য আমি গভীরভাবে ঋণী।
বিশ্ববিদ্যালয় হতে এত কিছু পাওয়ার আনন্দের মধ্যেও একটি হারানোর বেদনা সবসময় আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ১৯৯৮ সালের ১৮ ই মে আমার একমাত্র সন্তান কাজী মুশফিকুস সালেহীনকে মেডিকেলের ১ম বর্ষে পড়া অবস্থায় চিরতরে হারাতে হয়েছে। এভাবে অপরাজনীতির বলি হয়ে আর কোন মা-বাবার বুক যাতে খালি না হয় সে আবেদন জানাই সকলের কাছে।

লেখক : ডিন ও অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়