চন্দনাইশের বরকল ব্রিজ এলাকায় নৌকার গ্যারেজ

52

মো. শাহাদাত হোসেন, চন্দনাইশ

সম্মুখে জৈষ্ঠ্য ও আষাঢ় মাস। শুরু হবে বর্ষা মৌসুম। বাঙালী সংস্কৃতির ঋতু বৈচিত্র্যে বর্ষা মানেই রিমঝিম বৃষ্টি। বারিধারায় গ্রামের মাঠঘাট জল থৈ থৈ করে এবং বর্ষার পানিতে নদী ভরে উঠে। নদীর তীরের গ্রাম, চরাঞ্চল এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে নৌকাই বাহন। জেলেদের মাছ ধরার বাহন নৌকা। শুধু চরগ্রাম নয় বন্যা থাবা দিলে জনমানব চলাচলে নৌকাই একমাত্র বাহন হয়ে দাড়াঁয়। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক নৌকা, কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সহ¯্রাব্দের পথে। নৌকা কালের পরিক্রমায় চিরন্তন হয়েই আছে। চৈত্রের শেষেই নৌকা ঠিকঠাক করার কাজ শুরু হয়েছে চন্দনাইশের শঙ্খ নদী ও চাঁনখালী খালের বিভিন্ন পয়েন্টে। মোটর গাড়ির যেমন গ্যারেজ আছে হালে নৌকারও গ্যারেজ গড়ে উঠেছে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। শঙ্খ নদীর তীরবর্তী বৈলতলী বসরত নগর ঘাটঘর, চর বরমা ঘাটঘর, চাগাচর, চাঁনখালী নদীর কেশুয়া, যতরমুখ, ধোপাছড়ি ঘাটঘর, বরকল ব্রীজ এলাকায় গড়ে উঠেছে নৌকা ঠিকঠাক করার ওয়ার্কশপ। যেখানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে নৌকা এনে ঠিকঠাক করা হচ্ছে। নৌকা কখনও আসে ভ্যানগাড়িতে। কখনও নৌকার ওপর নৌকা তুলে নদীপথে আনা হয়।
বরকলে নৌকার কারিগর আবদুল আলীম বলেছেন, কাঠ দিয়ে ঠিকঠাকভাবে নৌকা বানিয়ে কাঠের পাটাতন সেট করতে হয়। ছই লাগানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এরপর গাব আলকাতরা দিয়ে ফিটিং করতে হয়। তারপর কাছের জলাশয়ে টেস্ট করা হয় পানি ওঠে কিনা। নদী পথের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একদার স্টিমার আজ আর চোখে পড়ে না। আধুনিক যুগের যন্ত্রযানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিংবদন্তির নৌকা বসে নেই। যে মাঝি-মাল্লারা এক সময় চৌর ও বৈঠায় নৌকা বাইত তারা এখন শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকায় মোটরগাড়ির ইগনিশনের (চাবি দিয়ে স্টার্ট) মতো নৌকা স্টার্ট দেয়। মাঝিকেও নৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণে হাল ধরে রাখতে হয়। দেশের প্রতিটি এলাকায় এখন সকল ধরনের নৌকা আছে। কোনটি বৈঠা বওয়ার সাধারণ নৌকা। কোনটি শ্যালো ইঞ্জিনে চালিত। দেশে অনেক ধরনের নৌকা আছে। আবার একদার ঐতিহ্যের অনেক নৌকা হারিয়েও গিয়েছে। তারপরও নৌকার আবেদন এতটাই বেশি যে গ্রামে গৃহস্থবাড়িতে নৌকা আছেই। হালে কৃষকের বাড়িতে নৌকা থাকে। যারা ঘাটে নৌকায় যাত্রী পারাপার করে তারা ব্যবসায়ী ভিত্তিতে একাধিক বড় ও মাঝারি নৌকা বানায়। আগে খেয়া ঘাটে মাঝি নৌকা নিয়ে থাকত। এখনও থাকে তার সঙ্গে গৃহস্থ ও কৃষকেরও নিজস্ব নৌকা ও ডিঙি নৌকাও ভিড়ানো থাকে।
ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রতিটি পরিবাওে মোটরগাড়ি আছে। তেমনই বাংলাদেশের নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরগ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নৌকা এখন অতি প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই গাঁও ঐ গাঁও এই হাট সেই হাটে পণ্য বাজারজাত করণসহ নানা কাজে নৌকাই একমাত্র মাধ্যম। মোটরগাড়ি সচল রাখতে গ্যারেজে নিতে হয়। নৌকাকে ঠিকঠাক রাখা ও মেরামতের সময় শুকনো মৌসুম থেকে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত দেশের প্রতিটি এলাকায় নৌকা মেরামতের কাজ চলে।
এই সময়টায় নদ নদীতেই পানি কমে যায়। অনেক নদীতে চর জেগে ওঠায় সামান্য পানি হেঁটেই পার হওয়া যায়। খেয়া ঘাটে নৌকা বেশি থাকে না। বেশিরভাগ নৌকাই এখন মিস্ত্রিদের কাছে। হালে নৌকার মিস্ত্রিদের পদবি বাড়িয়ে নাম হয়েছে বোট মেকানিক। বরকল ব্রীজ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নতুন নৌকা তৈরির পাশাপাশি পুরনো নৌকা মেরামতের কাজ চলছে। বৈশাখে একদিকে নতুন ধান মাড়াই-কাটাই শুরু হয়ে যায়, আরেকদিকে গৃহস্থ ও কিষান বাড়িতে নৌকা ঠিকঠাকের কাজ চলে। একটা সময় নৌকায় সামনে ময়ূরের আকুতি বানিয়ে ভেতরে লঞ্চের মতো দোতলা করে ময়ূর পঙ্খী নাও বানানো হতো। এখন আর সেই নৌকা নেই। এখন সকল নৌকা জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তৈরি করা হয়। বর্ষা মৌসুমে যে নৌকা বাইচ হতো সেই নৌকাও আলাদাভাবে বানানো হতো।
চন্দনাইশ শঙ্খ নদী ও চাঁনখালী তীরবর্তী এলাকায় এখনো বিভিন্ন চরাঞ্চলের মানুষ নৌকা ব্যবহার করে চলাচল করে থাকে। তবে আগের তুলনায় অনেক কম ব্যবহার হচ্ছে নৌকা। এখন নৌকায় করে বালি, মাছ, বিভিন্ন পণ্য আনা-নেয়া করা হয় বেশি।