চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

67

বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন শেখ হাসিনা, যার নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিল আওয়ামী লীগ।
গতকাল সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় দরবার হলে মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন ও গোপনীয়তার শপথ নেন।
প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর নতুন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম।
রাষ্ট্র পরিচালনায় এবার শেখ হাসিনার সঙ্গী হচ্ছেন ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং তিনজন উপমন্ত্রী। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় জয়ের পর শেখ হাসিনা তার নতুন সরকার সাজিয়েছেন মূলত নতুনদের নিয়ে। খবর বিডিনিউজের
শেখ হাসিনা শপথ নেওয়ার পর ছোট বোন শেখ রেহানা তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন সূচনায় পরস্পরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য সাজেদা চৌধুরী দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বুকে জড়িয়ে নেন, গালে চুমু খান। পরে হাত নেড়ে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসন গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।
শেখ রেহানা ছাড়াও তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক স্ত্রী পেপপিকে নিয়ে এসেছিলেন নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই সাংসদ শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাউদ্দিন জুয়েলও শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সিইসি কে এম নূরুল হুদা এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা নতুন সরকারের অভিষেকে উপস্থিত ছিলেন।
গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে বাসসের প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, বিডিনিউজ’র প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, একুশে টিভির সিইও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এবং চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ এসেছিলেন শপথ অনুষ্ঠানে।
মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যরা শপথ নিতে বঙ্গভবনে আসতে শুরু করেন বেলা ৩টার আগেই। তারা একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন, মেতে ওঠেন হাস্যরসে।
নতুন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেখা যায়। আগের সরকারের মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, নুরুল ইসলাম নাহিদ, শামসুর রহমান শরীফের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে দোয়া চান নতুন অনেকে।
একাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসার সিদ্ধান্ত নেওয়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বা তার স্ত্রী গত সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদকে নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। তবে জোট শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব আবদুল মান্নান ও যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী এবং জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম উপস্থিত ছিলেন দরবার হলে।
নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত, এ এইচ মাহমুদ আলী, আমির হোসেন আমু, মতিয়া চৌধুরী তোফায়েল আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, কামরুল ইসলাম, শামসুর রহমান শরীফ শপথ অনুষ্ঠানে ছিলেন। গত সরকারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা এইচ টি ইমাম, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও গওহর রিজভীও ছিলেন বঙ্গভবনে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিকালে বঙ্গভবনে পৌঁছালে রাষ্ট্রপতি তাকে স্বাগত জানান। পরে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান কিছুক্ষণ একান্তে আলাপ করেন বলে বঙ্গভবনের এক কর্মকর্তা জানান।
সাড়ে ৩টা দরবার হলে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। শপথ অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গভবনের মাঠে চা চক্রে যোগ দেন সবাই। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলেন। নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ায় ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি গঠিত পুরনো সরকারের দায়িত্ব শেষ হল। প্রধানমন্ত্রী পরে নতুন করে তার উপদেষ্টা নিয়োগ দেবেন।
শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হাসিনা ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই বোন হাসিনা ও রেহানা। পরের ছয় বছর লন্ডন ও দিল্লিতে তাদের নির্বাসিত জীবন কাটে।
১৯৮১ সালের ১৭মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। পাঁচ বছরের মাথায় সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের সময়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে বসেন বিরোধী দলীয় নেতার আসনে।
তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯০ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে মিলে একনায়ক এরশাদ সরকারের পতন ঘটায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে গিয়ে আবার বিরোধী দল হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।তার সেই সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির কথা বলা হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে তৃতীয়বারের মতো বিরোধী দলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা। ওই সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর আরও অনেক রাজনীতিবিদের মত শেখ হাসিনাও গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের মাথায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা।
বিএনপি ও তাদের শরিকদের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের ভোট হয়, তাতে ২৩১টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। সেই সরকারের মেয়াদ শেষে গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত সব দলই অংশ নেয়। ভোটের ফলাফলে ২৯৮ আসনের মধ্যে ২৫৭টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে তারা পায় ২৮৮ আসন।
গত ৩ জানুয়ারি সকালে জাতীয় সংসদে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে শেখ হাসিনাকে সংসদ নেতা নির্বাচিত করা হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বিকালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে টানা তৃতীয় মেয়াদে তাকে সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রপতি।
গতকাল সোমবার শপথ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চতুর্থ মেয়াদ শুরু করলেন শেখ হাসিনা। বিশ্বের নারী নেত্রীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি দিন সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কাতারে শেখ হাসিনার অবস্থান মেয়াদের দিক দিয়ে তৃতীয়।
উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকে আধুনিক বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান ছিলেন। সিলন ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তিন দফায় ১৭ বছর ২০৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই দফায় মোট ১৬ বছর ১৫ দিন তিনি ভারত সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত দুই দফায় মোট ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। গতকাল সোমবারই তিনি শপথ নিয়েছেন আরও পাঁচ বছরের জন্য। এই মেয়াদ পুরো হলে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন তিনি।
ক্যারিবিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া ডোমিনিকা প্রজাতন্ত্রের ইউজিনিয়া চার্লস ক্ষমতায় ছিলেন ১৪ বছর ৩২৮ দিন।
২০০৫ সাল থেকে একটানা ১৩ বছর জার্মানির ক্ষমতায় আছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল। ২০২১ সালে নির্বাচনের পর অবসরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে রেখেছেন তিনি। আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে একটানা ১২ বছর ৬ দিন দায়িত্ব পালনের পর এলেন জনসন সারলিফ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা ছাড়েন। আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বের নারী রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে এই ছয়জনই একযুগের বেশি সময় সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়া যাবেন কাল : চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে আগামীকাল বুধবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বুধবার সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে ফাতেহাপাঠ ও তার পিতার রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া মোনাজাতে অংশ নেবেন। এ সময় সশস্ত্র বাহিনী আর্ড অব অনার প্রদান করবে।
প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-১ কাজী নিশাত রসুল স্বাক্ষরিত গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকারের কাছে পাঠানো এক ফ্যাক্স বার্তায় এসব তথ্য জানা গেছে।
দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। দুপুর ১টায় তিনি ঢাকা পৌঁছাবেন।