চট্টগ্রাম থেকে যে তারকা ছুঁয়েছে সুরের আকাশ

28

পূর্বদেশ ডেস্ক

দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘নগর বাউল’ এর কর্ণধার ও ভোকালিস্ট ফারুক মাহফুজ আনাম। সবার কাছে যিনি ‘জেমস’ নামে পরিচিত। কিংবদন্তি এই রকস্টার ভক্তদের কাছে ‘গুরু’ নামেও পরিচিত। বাংলা গানের বিশাল জায়গা জুড়ে দখল জেমসের। দেশের গন্ডি পেরিয়ে উপমহাদেশের জনপ্রিয় তারকা এখন জেমস।
জেমসের ৫৭তম জন্মদিন ছিল শনিবার। ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর নওগাঁয় জন্ম। তবে বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। জেমস নামটি রেখেছিলেন তাঁর বাবা মোজাম্মেল হক। তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর মা জাহানারা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। জেমসের তিন সন্তান-ছেলে দানেশ, মেয়ে জান্নাত ও জাহান। জেমসের ছোট ভাই রুশো এখনো আছেন নওগাঁয়, দেখাশোনা করেন পারিবারিক ব্যবসা।
ছেলেবেলা থেকেই গানের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে জেমসের। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হাতে তুলে নিয়েছিলেন গিটার। গানের প্রতি আকর্ষণ থাকায় পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। তাই গান করা নিয়ে আপত্তি ছিল বাবার। নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা যখন বুঝলেন ছেলের আর পড়াশোনা সম্ভব নয়, তখন ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো জেমসকে। কিশোর বয়সে চরম বাস্তবতার মুখে ঠাঁই হলো বোর্ডিংয়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রামের ১২ বাই ১২ স্কয়ার ফিটের আজিজ বোর্ডিংয়ে শুরু হলো জেমসের নতুন জীবন। নিজের ঘর গানের জন্য পর হয়েছে কিন্তু হার মানেননি জীবন সংগ্রামে। চট্টগ্রাম থেকে তিনি ছুঁয়েছেন সুরের আকাশ।
বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যান্ড ‘ফিলিংস’। সেসময় সারাদিন গান তৈরিতে কেটে যেতো তার। আর সন্ধ্যা গড়ালেই চলে যেতেন নগরীর নাইট ক্লাবে গান গাইতে। একসময় চট্টগ্রামের মায়া ছেড়ে নিজেদের সৃজনশীল মৌলিক গান করার জন্য ঢাকা চলে আসেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় এসে প্রথম অ্যালবামের কাজ শুরু করেন জেমস। ১৯৮৭ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ প্রকাশ হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে আসে তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’। ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেন ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবাম। এই অ্যালবামের টাইটেল গানটি দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। একে একে প্রকাশ হয় ‘নগর বাউল’ (১৯৯৬), ‘লেইস ফিতা লেইস’ (১৯৯৮), ‘দুষ্টু ছেলের দল’ (২০০১), ‘পালাবে কোথায়’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯), ‘আমি তোমাদেরই লোক’ (২০০৩), ‘জনতা এক্সপ্রেস’ (২০০৫), ‘তুফান’ (২০০৭) এবং ‘কাল যমুনা’ (২০০৮) অ্যালবাম।
১৯৯৬ সালে ফিলিংস ব্যান্ড থেকে ‘নগরবাউল’ প্রকাশের পর থেকে ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে নগরবাউল রাখেন জেমস। এই নামে ব্যান্ড থেকে প্রকাশিত একমাত্র অ্যালবাম ‘দুষ্টু ছেলের দল’। এখনো পর্যন্ত ‘নগরবাউল’ নামেই গান পরিবেশন করছেন জেমস ও তার দলের সদস্যরা।
বাংলাদেশি সিনেমায় জেমসের গান বেশ জনপ্রিয়। দুইবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সিনেমায় তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘দশমাস দশদিন’, ‘আসবার কালে আসলাম একা’, ‘মীরাবাঈ’, ‘দেশা আসছে’, ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’, ‘পাগলা হাওয়ার তরে’, ‘এত কষ্ট কষ্ট লাগে কেন অন্তরে’ এবং ‘বিধাতা’। শুধু দেশিয় প্লে­ব্যাক নয়, বলিউডেও রাজত্ব করেছেন এই রক তারকা। তার গাওয়া বলিউডের ‘ভিগি ভিগি’, ‘চাল চালে’, ‘আলবিদা’, ‘রিশতে’ এবং ‘বেবাসি’ গানগুলো এখনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। অন্যান্য জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘তারায় তারায়’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘সুস্মিতার সবুজ ওড়না’, ‘হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা’, ‘কবিতা তুমি স্বপ্নচারিণী’, ‘দিদিমনি’, ‘তোর সব কিছুতে নয় ছয়’, ‘বাবা কত দিন দেখি না তোমায়’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘এক নদী যমুনা’ ইত্যাদি।
জেমসকে এখন পাওয়া যায় ইউটিউবে। নব্বইয়ে জেমস ছিলেন গানের ফেরিওয়ালা। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, রাজশাহী থেকে বরিশাল গান ফেরি করতেন। পুরোনো গান যেমন খুঁড়ে তুলে আনে পুরোনো স্মৃতি, সেভাবে ইউটিউবে একা হেডফোনে জেমসের কণ্ঠ মানুষকে স্মৃতিতে ভাসায়। আশৈশব যারা জেমস শুনেছেন, তাদের হয়তো প্রায়ই মনে হয়, জেমস কোথায়! জেমস এখন ‘আলোকচিত্রী’। মডেলদের সাজিয়ে ফ্রেমবন্দী করেন। একইসঙ্গে ছবি আঁকা আর স্থিরচিত্র রচনার আনন্দে কাটে তাঁর সময়। জন্মদিনে ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘গান করছি, এটাই আমার আনন্দ, এটাই আমার প্যাশন। তারপর কী হয়েছে না হয়েছে ভাবিনি। কিছু না হলেও গানই করতাম। যতোদিন তোমরা আছো, ততোদিন আমি আছি।’