‘চট্টগ্রাম টু ইতালি’ সরাসরি ইউরোপ যাত্রা, রপ্তানিতে নতুন দিগন্তের আশা

37

পূর্বদেশ অনলাইন
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে শনিবার আসছে ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’; যা এখন সমুদ্রগামী নৌ পরিবহন খাতের আলোচনায়।
নামের কারণে নয়; এ জাহাজকে ঘিরে বাংলাদেশের জন্য খুলতে যাচ্ছে নতুন সমুদ্র পথ, সেই সম্ভাবনাই সোঙ্গা চিতার আগমনকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ইউরোপ যাবে জাহাজ- এমন প্রত্যাশা বহুদিনের। সেই আশা এবার বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে, তাতে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন ব্যবসায়ীরা। গেল বছরের ডিসেম্বরে আরেকটি জাহাজের পরীক্ষামূলক যাত্রা সফল হওয়ায় এবার নিয়মিত যাত্রা শুরু হচ্ছে। এখন থেকে দুটি জাহাজ নিয়মিত চলবে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইউরোপের পথে। বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম বৃহৎ গন্তব্য ইউরোপের দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানি হয় অন্য দেশের বন্দর ঘুরে। সেখানে অপেক্ষায় থাকতে হয় বড় জাহাজের বুকিং পেতে। এতে ক্রেতাদের হাতে পণ্য পৌঁছাতে দেরি হয়, খরচও বাড়ে। প্রতিযোগীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ এটাও।
সেই বাধা দূর করতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রথমবারের মত ইউরোপের গন্তব্য ইতালিতে শুরু হচ্ছে জাহাজে করে সরাসরি রপ্তানি পণ্য পরিবহন। শুরুতে কিছুটা ছোট পরিসরে ও ছোট জাহাজে করে কন্টেইনার পরিবহন হলেও এ উদ্যোগ আশা জাগাচ্ছে রপ্তানিকারকদের। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে ৯৮৩ রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার নিয়ে যাত্রা করবে ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’। সেজন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দেশের এ প্রধান সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান জানান, এমভি সোঙ্গা চিতা জাহাজটিকে সরাসরি বার্থিংয়ের সুবিধা দেওয়া হবে, যাতে অপেক্ষায় থাকতে না হয়। এছাড়া গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ সব কারিগরি ও প্রশাসনিক কাজেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, যাতে দ্রুত সেটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারে। ইতালিসহ ইউরোপের কয়েকজন ক্রেতার আগ্রহেই ইতালির ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠান আরআইএফ লাইন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান ক্যালিপসো কোম্পানিয়া ডি নেভিগেশন চট্টগ্রাম-ইতালি সরসারি জাহাজ চলাচলের এই সেবা চালু করছে।
এ সেবার স্থানীয় প্রতিনিধি রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেডের চেয়ার‌ম্যান মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, ৯৪৫ টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারের সমতুল্য একক) খালি কন্টেইনার এবং ক্যাপিটাল মেশিনারি ভর্তি সাত টিইইউএস কন্টেইনার নিয়ে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে শনিবার।
“ফেরার সময় ৯৮৩ টিইইউএস কন্টেইনার নিয়ে যাবে, যেগুলোর ৯৮ শতাংশই তৈরি পোশাক। ইতালির ক্রেতাদের পাশাপাশি ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশের ক্রেতাদের অর্ডার করা তৈরি পোশাক থাকবে তাতে।” এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর ইতালি থেকে খালি কন্টেইনার নিয়ে পরীক্ষামূলক যাত্রায় চট্টগ্রামে পৌঁছায় ‘ক্যাপ ফ্লোরেস’ নামের একটি জাহাজ। নতুন এ সমুদ্রযাত্রাকে শুধু ইতালির বন্দরে একটি রপ্তানি পণ্যবাহী জাহাজের যাত্রা হিসেবে দেখতে রাজি নন রপ্তানিকারক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা।
তারা বলছেন, এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ‘নতুন দিগন্ত’ উন্মোচিত হবে। সরাসারি যাত্রায় খরচ ও সময় কমলে ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি আমেরিকান ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন এ ব্যবস্থায়।
সেক্ষেত্রে পোশাক রপ্তানি খাতে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারবে বাংলাদেশ। বিদেশি ক্রেতাদেরও এ দেশ থেকে পণ্য কেনার আগ্রহ বাড়বে, যা এগিয়ে দেবে অর্থনীতিকে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো, মালয়েশিয়ার কেলাং ও তেনজুং পেলাপাস এবং চীনের কয়েকটি বন্দরে সরাসরি কন্টেইনারবাহী জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে বেশি গভীরতার বড় আকারের জাহাজ ভিড়তে না পারায় রপ্তানি পণ্যবাহী মাঝারি ও ছোট আকারের জাহাজে পণ্য নিয়ে যেতে হয় ওইসব বন্দরে। সেখান থেকে বড় জাহাজে করে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে যায় রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারগুলো। কোভিড মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ২০২১ সালের শুরুর দিকে তৈরি পোশাক রপ্তানির চাপ বাড়তে থাকলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে সময়মত বড় জাহাজে বুকিং মিলছিল না। এমনকি পর্যাপ্ত কন্টেইনারেরও সঙ্কটও দেখা দেয়। ফলে রপ্তানি পণ্য পাঠাতে খরচ ও সময় দুটোই বেড়ে যাচ্ছিল।
ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি খায়রুল আলম বলেন, “গত বছর এরকম পরিস্থিতি যখন, তখন রপ্তানিকারকরা ক্ষতির মুখে পড়ছিলেন। কারণ বিদেশি ক্রেতারা সময়মত পণ্য পাচ্ছিলেন না। “তখন বিজেএমইএর সঙ্গে এক বৈঠকে প্রস্তাব করি সরাসরি ইউরোপের বন্দরগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যাঞ্জেলেস বন্দরে যদি পণ্যবাহী জাহাজ চালু করা যায়। তখন তা অনেকেই অবাস্তব ভেবেছিল।” তিনি বলেন, “মহামারী পরবর্তী বিশ্বে এখন একটি ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার ইউরোপের গন্তব্যে পৌঁছাতে ভাড়া পড়ে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে গেলে প্রায় ১৬ হাজার ডলার। কিন্তু সরাসরি জাহাজে গেলে তা কমে হবে ১০ হাজার ডলারের নিচে। এছাড়া অর্ধেক সময়েই গন্তব্যে পৌঁছাবে কন্টেইনার।
“ফলে দুদিক থেকেই ক্রেতা সন্তুষ্ট থাকবে। এতে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ভালো হবে। সঠিক সময়ে ও কম খরচে পণ্য পেলে নতুন ক্রেতারাও এ দেশের প্রতি আকৃষ্ট হবে।”
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, “এই যাত্রা শুধু ইতালিতে পণ্য রপ্তানি নয়। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানির নতুন দুয়ার খুলে যাবে।
“আমাদের রপ্তানির ৪০ শতাংশই যায় ইউরোপের দেশগুলোতে। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগে ৩০ দিনের মত। এই সার্ভিসে আগের তুলনায় পণ্য পৌঁছাবে অর্ধেক সময়ে। খরচও কমবে। এটা সফল হলেই ইউরোপের অন্য দেশগুলোও সরাসরি জাহাজে পণ্য পরিবহন শুরু করে দেবে বলে আমার বিশ্বাস।” চট্টগ্রাম-ইতালি পথে মাসে দুটি জাহাজ চলাচল করবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সংখ্যা আরও বাড়লে এবং সঙ্গে যদি বড় আকারের জাহাজ চলাচল শুরু হয় তাহলে এর পুরো সুফল মিলবে।” ইতালির আশেপাশে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের ক্রেতা অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, বুলগেরিয়া, স্পেন, রুমানিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থাকায় এ যাত্রার সাফল্য সেসব দেশকেও সরাসরি পণ্য পরিবহনে আগ্রহী করে তুলতে পারে বলে মনে করেন তিনি। শনিবার বিকেল তিনটার দিকে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়বে বলে জানান তিনি। সবকিছু ঠিক থাকলে ৭ ফেব্রুয়ারি সেটি ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।