চট্টগ্রাম কতটা ঝুঁকিতে?

56

এম এ হোসাইন

তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। এ ভূমিকম্পকে সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলোর একটি বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়াতেও ভূমিকম্প হয়েছে। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। ফল্ট লাইনের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বেশি ঝুঁকিতে আছে। এ অবস্থায় ভূমিকম্প নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তুরস্ক-সিরিয়ার ও ইন্দোনেশিয়ার পর কি বাংলাদেশের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূত্বকের বিশাল খন্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্ট লাইন বলা হয়। ফল্ট লাইন দিয়ে ২ প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়। তেমনি বাংলাদেশের মূল ভূ-ভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এরকম মোটামুটি ৫টি ফল্ট লাইন আছে। চট্টগ্রাম ভারতীয় ও ইউরেশিয় টেকটোনিক প্লেটের সীমানার কাছাকাছি অবস্থানে। চট্টগ্রাম দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ফল্ট লাইনের কাছাকাছি অবস্থিত। যার কারণে চট্টগ্রামে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে ভূমিকম্পের অবস্থান, গভীরতা এবং মাত্রাসহ বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে ঝুঁকির সঠিক মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে। অবস্থানগত কারণে রিখটার স্কেলে সাত দশমিক পাঁচ থেকে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম। এই মাত্রায় ভূমিকম্প হলে নগরীর দেড় লাখ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ চুয়েটের সাবেক ভিসি এবং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি)-এর উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার,বাংলাদেশ-ভারত এবং মিয়ানমার-ভারত (পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে) সীমান্ত এলাকায়। এসব এলাকায় ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। আর তা হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম। এখন আমাদের দেখতে হবে বড় বড় যে মেগা প্রকল্প হচ্ছে সেগুলো ভূমিকম্প সহনশীল কিনা। কারণ কোনো মেগা প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের ভিশনে আঘাত আসবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পার্শ¦বর্তী দেশে ভ‚মিকম্প হলে আমাদের ঝুঁকি বেড়ে গেলো তেমনটা নয়। ভূমিকম্প যে কোনো সময় হতে পারে। যেহেতু আমরা ফল্ট লাইনের কাছাকাছি, তাই আমাদের বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।

কেন ভূমিকম্প হয় : পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্তে¡র মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোন বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন।

কেমন ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম : পলিমাটি দিয়ে গঠন, ব-দ্বীপ এবং তিনটি প্লেটের ওপর অবস্থান বাংলাদেশের। আবার প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টিবহুল এলাকায় অবস্থান বাংলাদেশের। ইউরেশিয়ান, ইন্ডিয়ান এবং বার্মিজ প্লেটের সঙ্গমস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোন ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। অর্থাৎ, তিনটি প্লেটের পারস্পরিক সংঘর্ষের কারণে দেশে ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। কিন্তু কবে বা কখন সেটা হবে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের ধারণা নেই।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ছোট বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে দেশ। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৭টি ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপেছে দেশ। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ২ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর। ২০২১ সালের ২৯ মে এক দিনেই টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পের কারণে সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কেমন ক্ষতি হতে পারে : বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে। পরবর্তী সময়ে ছোট ছোট কিছু ভূমিকম্প হলেও বড় মাত্রার কোন ভূমিকম্পের মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে গত ১০০ বছরে বড় কোন ভূমিকম্প না হওয়ায় ছোট কম্পনগুলো শক্তি সঞ্চয় করে সামনে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা তৈরি করছে বলে মনে করছেন ভূতত্ত¡বিদরা। আর ভূমিকম্পের সময় হতাহতের বড় একটি কারণই ভবনধস।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৫ সালের অন্য একটি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, যদি ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তবে চট্টগ্রাম শহরের ১ লাখ ৮২ হাজার ভবন, ১৬২ হাসপাতাল ভেঙে যাবে। এতে ১৭ মিলিয়ন টন আবর্জনা তৈরি হবে যা সরাতে ৬ লক্ষ ৮০ হাজার ট্রাকের ট্রিপ প্রয়োজন হবে। শহরের ১০৩৩ স্কুলের মধ্যে ৭৩৯ বিল্ডিং পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। চট্টগ্রামে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যার মধ্যে ৭৩ হাজার থাকবে স্কুলের শিক্ষার্থী।
২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল এক প্রতিবেদনে বলেন, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তথ্য মতে রিখটার স্কেল ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৭৫ শতাংশ বিল্ডিং আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ৬১ শতাংশ বিল্ডিং ভেঙে পড়তে পারে। রাতে সংঘটিত একটি ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করবে এবং ৭ হাজার মানুষকে তাৎক্ষনিকভাবে হাসপাতালে নিতে হবে। এক লাখেরও বেশি মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও অন্যান্য মেডিকেল সেবা দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। প্রায় ৩০ভাগ মানুষ ভগ্ন ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পড়বে। যাদের খুঁজে বের করে উদ্ধার করতে হবে।
ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে কি ব্যবস্থা : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশের ভূমিকম্পের পর তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে অবিলম্বে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া উচিত আমাদের। কারণ যেকোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশ ভূমিকম্প মোকাবেলায় তেমন কোন প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। ভ‚মিকম্পে সবচেয়ে বেশি ভবন ধ্বসের ঘটনা ঘটবে। ভবন নির্মাণে ন্যূনতম মান নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হলেও সেটার বাস্তবায়ন এখনো সেভাবে হয়নি।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, গত দুই দশকে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত উপাদানের মান উন্নয়ন হলেও, সার্বিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। তার মতে, উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে বেশ বড় অংকের বিনিয়োগ থাকায় নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেছে। কিন্তু পাঁচ থেকে ছয় তলা ভবন নির্মাণে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।