চট্টগ্রামে ৭২ ভাগ রোগীর অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস

58

ফারুক আবদুল্লাহ

এমন কোনো পরিবার নেই, যেই পরিবারে ডায়াবেটিসের রোগী নেই। চট্টগ্রামে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগীর নতুন করে ডায়াবেটিস শনাক্ত হচ্ছে। যাদের মধ্যে মধ্য বয়সী রোগীর সংখ্যা বেশি। এবং প্রতি ৭ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া চট্টগ্রামের প্রায় ৭২ ভাগ রোগীরই ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত। তাদের মধ্যে মহিলাদের, বিশেষ করে গৃহিনীদের সংখ্যাই বেশি। এ রোগ এখন পরিবার, রাষ্ট্র ও সারা বিশ্বের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স¤প্রতি ১২৫৩ জন ডায়াবেটিস রোগীর উপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ডায়াবেটিস রোগীর প্রায় শতকরা ৮২ ভাগেরই অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। তার মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগেরই অত্যন্ত বেশী মাত্রায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। এবং প্রতিজন ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে বছরে ব্যয় ৮৬৫ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ওষুধ বাবদ ব্যয় ৬০ ভাগ এবং হাসপাতালে ভর্তিজনিত ব্যয় ২৮ ভাগ। দীর্ঘ মেয়াদি ডায়াবেটিস, ইনসুলিনের ব্যবহার ও ডায়াবেটিস রোগের জটিলতাজনিত কারণই এই ব্যয়ের পেছনে দায়ী। এই গবেষণাটি করা হয়েছে দেশের রাজধানী ও উত্তরাঞ্চলের ডায়াবেটিস রোগীদের উপর।
অন্যদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে একটি গবেষণা করা হয়েছে। তাতেও একই চিত্র উঠে এসেছে। চট্টগ্রামের প্রায় ৭২ ভাগ রোগীরই ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত এবং তাদের মধ্যে মহিলাদের, বিশেষ করে গৃহিণীদের সংখ্যাই বেশি। যদিও এ বিষয়ে তেমন কোনো ডাটা নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে, চট্টগ্রামে প্রতিদিন নতুন করে শনাক্ত হচ্ছেন ১০০ থেকে ১৫০ জন ডায়াবেটিস রোগী। যাদের মধ্যে মধ্য বয়সী রোগীর সংখ্যা বেশি। প্রতি ৭ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ৫৪১ মিলিয়ন রোগীর ডায়াবেটিস হবার পূর্ববর্তী ধাপে আছে, যাকে প্রি-ডায়াবেটিস বলা হয়। এই রোগীরা পরবর্তীতে ডায়াবেটিস হবার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।
দেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম ছিল। যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে উঠে আসবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। যেমন বাংলাদেশ ও ভারত। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রæত নগরায়ণ, সুষম খাদ্য গ্রহণের তারতম্যের কারণে মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাংক্সিক্ষত হারের চেয়ে বেশি। কায়িক পরিশ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ১ শতাংশ। দেশের শূন্য থেকে ১৯ বছরের টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩৫০ জন।
আইডিএফের ২০২১ সালের তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫৩৭ মিলিয়ন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এটি ৬৪৩ মিলিয়ন এ পৌঁছুবে। এর মধ্যে ৯০ মিলিয়ন বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রতি ১০ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ২ জনের মধ্যে একজনই জানেন না, যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ৫ জনে ৪ জনই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে বাস করেন। ২০২১ সালে এ পর্যন্ত ডায়াবেটিসে প্রায় ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গড়ে প্রতি ৬টি সন্তান প্রসবের ১টি মা ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত, যার শতকরা ৮০ ভাগ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি এই রোগের পেছনে ব্যয় হয়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫০ ভাগেরই ডায়াবেটিস আছে। এছাড়া কোভিড সেরে উঠার পরও অনেকে নতুনভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রতি রোগীর নিজের এবং পরিবারের সদস্যের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৯ সালে আউটডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ডায়াবেটিস রোগী, ইনডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮০০ রোগী। এদের মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ নারী। আর ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আউটডোরে সেবা নিয়েছেন সাড়ে ৩ হাজার। যাদের মধ্যে ৩ ভাগের ২ ভাগ নারী। আর ইনডোরে সেবা নিয়েছেন ২৫০ থেকে ৩০০ জন ডায়াবেটিস রোগী। যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা দিগুণ। এছাড়া ২০২১ সালে এই পর্যন্ত আউটডোরে সেবা নিয়েছে সাড়ে ৩ হাজার এবং ইনডোরে সেবা নিয়েছে ৫৫০ জন। এসময় করোনা মহামারি পরিস্থিতির কারণে সেবা নিতে আসা রোগীর অনুপাতিক হার কমেছে।
এদিকে আজ রবিবার বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস হাসপাতালসহ সরকারি ও বেসেরকারি হাসপাতালে ডায়াবেটিস হেলথ ক্যাম্প অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, র‌্যালি, জনসচেতনতা মূলক প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে।