চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও নাট্যশিক্ষণ : প্রাসঙ্গিক আলোচনা

39

রেবা বড়ুয়া

নাটক সভ্যতার একটি বিশাল ও আদি শিল্প মাধ্যম। বাংলা সাহিত্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় সমাজের সকল অন্যায়, অসুন্দর ও অসঙ্গতি দূর হোক।
স্কুলে স্কুলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও নাট্যশিক্ষার কর্মসূচি শিশুর মেধা ও মনন বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
শিশুরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোলাপ, শিশুই হচ্ছে সমাজ বিনির্মাণের উত্তরাধিকার। তাদের আদর্শ সচেতন এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সবার দায়িত্ব। পরিবার, সমাজ, মা-বাবা এবং অভিভাবকরাই পারেন শিশুকে সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রী, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে তার সাথে জীবনের ঘনিষ্ঠতা খুবই সীমিত। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে শিশুর মনোবিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মসূচির সম্পর্ক তেমন জোরালো নয়। স্কুল পাঠ্যক্রমে নিয়মিত বিষয়সমূহ থাকলেও সহপাঠ্যক্রম বা সম্পূরক পাঠ্যক্রম কর্মসূচিতে সাংস্কৃতিক দিকটা চর্চাগতভাবে অনুল্লেখ্য পর্যায়ের।
প্রকৃত অর্থে একটি শিশুর মনোবিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক শিক্ষা তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের চর্চা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্টতা রেখে আনন্দময় শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা অপরিহার্য। শিশুদের সাংস্কৃতিক শিক্ষা ‘শিশু অধিকার সনদ’-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রী তথা তৃণমূল পর্যায়ে শিশু-কিশোরদের অধিকাংশই এই অধিকার থেকে বঞ্চিত।
শিশুদের মানবিক বিকাশ জাতির অগ্রগতিতে অপরিহার্য উপাদান। এই সত্যকে মেনে নিয়ে বলতে হবে, প্রতিটি শিশুর দেহ, মন, সৃজনশীলতা ও মননশীলতা বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক শিক্ষার কর্মসূচি প্রয়োজন।
কেননা সাংস্কৃতিক চর্চা যেমন অনেকগুলো পরিপূরক মাধ্যমকে একত্রিত করে অনুশীলনের বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করে, তেমনি থিয়েটার বিষয়টিও বহুমুখী বিকাশধর্মী একটি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়, যা সম্পূরক শিক্ষামাধ্যম হিসেবেও বিবেচ্য হতে পারে। সুস্থ জাতি গঠনে সুস্থ নাগরিক প্রয়োজন। সুস্থ নাগরিক বলতে দুটি অর্থ বুঝিÑ যিনি হবেন যেমন সুস্থ দেহী, তেমনি হবেন সুস্থ মানসিকতার। সুস্থ দেহের জন্য মুখ্য শর্ত সার্বিক ব্যায়াম। থিয়েটার শিখন পদ্ধতিতে দেহের ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে শরীর চর্চা, কণ্ঠ চর্চা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, তাৎক্ষণিক উপস্থাপন এবং নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতা অত্যাবশ্যাক। তাই নাট্যশিক্ষণ স্কুলের সম্পূরক পাঠ্যক্রমে থাকলে ছাত্রছাত্রীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটবে। তৈরি হবে কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও শৃঙ্খলার সমন্বয়ে ভিতরের আত্মবিশ্বাসী মানুষটি আমাদের ও ভবিষ্যতের নাগরিক।
আমরা যারা শিক্ষার কথা বলি, যারা সংস্কৃতিকে সমাজ জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে মনে করি, তাদের কথা হলো- আমাদের স্কুল পর্যায়ে নাট্যশিক্ষণের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। দরিদ্র দেশ হিসেবে এই মুহূর্তে আমরা যদি জাতীয় উন্নয়নের একটি তালিকা তৈরি করি, তাহলে সেই তালিকা হয়ত অনেক দীর্ঘ হবে। কিন্তু আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি তালিকার ওপরদিকে থাকাই হবে স্বাভাবিক। তাই রাষ্ট্রের কাছে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও সুষম শিক্ষার প্রয়োজনে স্কুল পর্যায়ে কার্যকর সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ এবং থিয়েটার শিক্ষণের সম্পূরক পাঠ্যক্রম অনুমোদনের দাবি জানাই। এখন যেসব সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়সারা গোছের।
নাটক, গান, নাচ, চিত্রকর্ম প্রভৃতি একটি দেশকে, তার সময়কে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। যেহেতু শিল্প-সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের চিত্ত প্রকাশ পায়। তাই শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার প্রতি মনোযোগী করে তুলতে স্কুলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং নাটক (থিয়েটার) বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে তা শিক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং শিক্ষার প্রসার ঘটবে।
সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্য যেহেতু-মানুষের চিন্তার অপার শক্তিকে ব্যবহার করে সমাজের চলমান অসুন্দর, অন্যায়, দুর্নীতি, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা ও লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে মানবিক, কল্যাণকর, বিজ্ঞানমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। মানবতার জয়গান গাওয়া। মানবতা কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করে না। কারণ-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।’
যারা সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা তাদের সুন্দর একটা মন থাকে। কোনো অসুন্দর তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। যে মন কখনো বুড়ো হয় না, যুগে যুগে, সর্বকালে সর্বাবস্থায় সবসময় থাকে সজীব, প্রাণবন্ত ও তারুণ্যদীপ্ত। জীবনের পরতে পরতে, ঘাত-প্রতিঘাতে তার দীপ্তি, জ্যোতি বা আলো কখনো কখনো নিভু নিভু হলেও, তা একেবারেই নিভে যায় না। সুযোগ পেলেই আবার নিজস্ব দ্যুতি বা জ্যোতি নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়- জীবনের জয়গান গায় আমাদেরও ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা তা-ই হোক।
বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প মাধ্যম নাটক। এটি লেখ্যরূপ ছাড়িয়ে মঞ্চায়ন এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাপিয়ে বর্তমানে উভয় বঙ্গে একটি স্বতন্ত্র শিল্প-মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। বাংলা নাটকের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসে বহু-বিচিত্র খাত ও মাত্রা অতিক্রমণের বৃত্তান্ত জমা হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গে নাটক একটি শক্তিশালী-হাতিয়ারে উত্তীর্ণ।
বাংলাদেশের নাটকও প্রথমত পশ্চিম বঙ্গের সফল পরিক্রমার প্রেক্ষাপটে এবং দ্বিতীয়ত বাংলার নিজস্ব নাট্যধারার নিরিখে অর্জন করেছে প্রভুত সাফল্য। দুই বাংলার নাটক এমন সনিষ্ট ও একাগ্র গবেষণা নিঃসন্দেহে আগামি দিনের নাট্য সমালোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে।
পুনরায় বলি, আমাদের শিশুদের জন্য স্কুলের কারিকুলামে মূল পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও নাট্যশিক্ষণ কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এটা তাদের মেধা ও মনন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। তারা মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবেও তারা দেশকে এগিয়ে নিতে পারবে। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় দূর হবে সমাজের সকল অসঙ্গতি।

‘ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত হোক আগামী প্রজন্ম
নতুন ও পরিবর্তিত জীবনের জন্য সংস্কৃতি চর্চা অপরিহার্য।’

লেখক : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক