চট্টগ্রামে কি কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে

7

মো. দিদারুল আলম

চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং-এর হাত থেকে নিজের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে গত ১০ এপ্রিল হামলার শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চিকিৎসক কোরবান আলী। চট্টগ্রামে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অস্ত্রবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রায় সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কিশোররা। তাদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে ‘গডফাদাররা’। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নগরীর পাড়া-মহল্লায় প্রতিনিয়ত আধিপত্য বিস্তার এবং হিরোগিরি দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠছে কিশোররা। প্রতি বছর গ্যাংয়ে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। একের পর এক খুন, মাদক চোরাচালান, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ আজকে যে শিশু বা কিশোর সে হবে আগামী দিনের কর্ণধার। যারা কাজ করবে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য। যারা নেতৃত্ব দিবে দেশকে এবং তাদের ভিবিন্ন সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে নিজ দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে অংশীদার হবে। তাদের সফল ও গৌরবময় কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে নিজ দেশকে নতুন করে তুলে ধরবে। বিশ্বদরবারে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, বর্তমানে আমার এই নতুন প্রজন্ম ভয়াবহ হুমকির মুখে। আমাদের সোনালি কিশোররা হারিয়ে যাচ্ছে গহিন অন্ধকারে। জড়িত হচ্ছে মাদক, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধে এবং প্রকাশ করছে নিজেকে এক একটা কিশোর গ্যাং হিসেবে।
কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে অনেকেই রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। দিন যত যাচ্ছে ততই ভয়ংকর উঠছে কিশোর গ্যাং। দিন-দুপুরে তারা ছিনতাই করছে। কথায় কথায় মারামারি ও অস্ত্রবাজি করছে। খুন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত অর্ধশত খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের দৌরাত্ম্য কমাতে গত চার বছর আগে তালিকা করা হলেও সেটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে পাড়া-মহল্লার উঠতি বয়সি কিশোররা।
২০১৯ সালে নগরীর ৩০০ স্পটে সক্রিয় থাকা ৫৫০ কিশোর গ্যাং সদস্যের তালিকা করে সিএমপি। তাদের দমাতে শুরু করে অভিযান। অভিযানের মুখে বছরের শেষ দিকে দাপট কিছুটা কমলেও বন্ধ হয়নি কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা। পাহাড়তলী থানাধীন সাগরিকা বিটাক মোড়ে নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় কিশোর গ্যাং ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। জামাল খান ও চকবাজার ওয়ার্ডেও কিশোরগ্যাংয়ের অপতৎপরতা রয়েছে। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ৩০০ স্পটে বিশেষ করে উঠতি বয়সি কিশোররা বড় ভাইদের মাধ্যমে গ্যাংয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তারা মাদক ব্যবসা, ইয়াবা সেবন, মোটরসাইকেল ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়াচ্ছে। সামান্য বিষয় নিয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে তারা।
বিভিন্ন কারণে কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এর জন্য পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক পরিবেশসহ বিভিন্ন কিছু দায়ী। উঠতি বয়সি কিশোরদের মধ্যে সব সময় উদ্দীপনা কাজ করে। ফলে খারাপ দিকে প্রভাবিত হয় বেশি। এজন্য পরিবারকে ভূমিকা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শৈথিল্যও হতে পারে এর একটি বড় কারণ। হয়তো বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে কথিত রাজনৈতিক বড়ভাইরা তাদের ব্যবহার করছে। আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করলে এক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। ঠিকমতো নজরদারি করলে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বন্ধ হবে। তবে অভিভাবকদেরও সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
কিশোর অপরাধের মামলাও বেড়েছে চট্টগ্রাম আদালতে। বর্তমানে ২ হাজার ২৩২টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং সংক্রান্ত। অথচ তিন বছর আগে ২০২১ সালে কিশোর অপরাধের মামলা ছিল ১ হাজার ৮৮টি। কিশোরদের নানা অপরাধে কাজে লাগানো সহজ। ফলে সমাজের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী বিশেষ করে কাউন্সিলর, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তাদের ব্যবহার করছে। কারণ ভাড়াটে অপরাধী ব্যবহার করা অনেক খরচের ব্যাপার।
পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোর গ্যাং নিয়ে কথা বলেছেন। গত ৮ এপ্রিল তিনি কিশোর গ্যাং মোকাবেলার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সবাইকে যুক্ত হতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, অন্য অপরাধীদের মতো নয়, তাদের (কিশোর গ্যাং) ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। কিশোর অপরাধীরা যেন সংশোধনের সুযোগ পায় সেজন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা মূলত পশ্চিমা রীতিনীতি অনুসরণ করেই তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আকাশ সংস্কৃতি, তথ্য প্রযুক্তির অবাধ অপব্যবহারসহ পরিবার তথা অভিভাবকদের ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব। কেউ কেউ বলছেন, যৌথ পরিবারগুলোর ভাঙ্গন শিশুদের বিপথগামী করে তোলার অন্যতম কারণ। অল্প বয়সে মোবাইল ফোনে আসক্তি, দেশি-বিদেশি টেলিভিশনে অপরাধ বিষয়ক নানা অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন শিশুদের অনেক সময় বিপথে টানতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশ হ্রাস পাওয়ার কারণেও সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে বলে মনে করেন অনেকে।
কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি কারণ তাদের ছেলেমেয়ে কার সাথে মিশছে, কিভাবে বড় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। পরিবারের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে কিশোরদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু কিশোরদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, কলেজ শিক্ষক ও চিত্রনাট্য লেখক