চট্টগ্রামে আবারও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মৃত্যু

54

 

বোয়ালখালীতে মাদ্রাসা ছাত্রের গলাকাটা লাশ উদ্ধারের চারদিনের মাথায় এবার পাঁচলাইশে আরেক মাদ্রাসা ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১ টার দিকে পাঁচলাইশের মুরাদপুর পিলখানা এলাকার ‘আলী বিন আবী তালিব’ মাদ্রাসার ভেতর থেকে মো. আরমান হোসেন (১৪) লাশ উদ্ধার করা হয়। আরমান মুরাদপুরের মির্জারপুল এলাকার আব্দুল হামিদ সড়কের সর্দার বাড়ির মো. আব্বাসের ছেলে।
মাদ্রাসার ভেতরে মৃত অবস্থায় পাওয়া ছাত্রটিকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার পরিবার। তবে পুলিশের ধারণা, শিশুটি মাদ্রাসার চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়েই মারা গেছে। পাঁচলাইশ থানার ওসি মো. জাহেদুল কবীর পূর্বদেশকে বলেন, ‘মাদ্রাসার ভেতর দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গা থেকে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশের হাত-পা ভাঙা অবস্থায় ছিল। প্রাথমিকভাবে সিসিটিভি ফুটেজে ছেলেটি চারতলা ভবনে ছাদে উঠতে দেখা গেলেও নামতে দেখা যায়নি। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে সিঁড়ি দিয়েই নামতে হবে, নয়তো নিচে লাফ দিতে হবে। ছেলেটি গত সোমবার থেকেই নিখোঁজ ছিল। ছাদে ছেলেটির সাথে পাঁচ থেকে সাতজন ছেলে ছিল। আমরা তাদের সাথেও কথা বলেছি। তারা ছেলেটি কোথায় গেছে দেখেনি বলে জানিয়েছে। দু’একদিনের ভেতর ঘটনার রহস্য বের হবে। মাদ্রাসার ওই ভবনের ছাদে আবার রেলিংও ছিল না। একপাশে থাকলেও তা প্রতিরক্ষা দেয়ার মতো না। যদি হত্যাকান্ড নাও হয় তাহলে এটি অবহেলাজনিত মৃত্যুও হতে পারে। যার দায়ভার নিতে হবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকেই’। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত মামলা হয়নি জানিয়ে ওসি বলেন, মাদ্রাসা ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় এখনোও লিখিত অভিযোগ পাইনি। আমরা জিডি করেই ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠিয়ে দিয়েছি। হয়তো লাশ দাফনের পর পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দেয়া হবে। গত সোমবার বিকেল ৫টা থেকে নিখোঁজ ছিল মাদ্রাসা ছাত্র আরমান। মাদ্রাসার লোকজন তাকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে সন্ধ্যায় আরমানের পরিবারকে ফোন দিয়ে ছেলে নিখোঁজের কথা জানায়। রাতেও আরমানকে খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া যায়নি। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে মাদ্রাসার ভেতরে আরমানের খোঁজ মিলেছে বলে পরিবারকে জানানো হয়।
আরমানের বাবা মোহাম্মদ আব্বাস বলেন, ছেলে নিখোঁজ বলে মাদ্রাসা থেকে জানানো হয়। সবখানে খুঁজেও ছেলেকে পাইনি। সকালে (মঙ্গলবার) মাদ্রাসা থেকে ফোন দিয়ে বলা হয় আমার ছেলেকে পাওয়া গেছে। আমি তড়িঘড়ি করে মাদ্রাসায় গিয়ে দেখি আমার ধন আর নেই। আমার ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে। অথচ আমার ছেলে রবিবারও বাসায় এসেছিল। তখন মাদ্রাসায় ছেলেদের বেশি মারধর করা হয় বলে জানিয়েছিল।
আব্বাস বলেন, তারেক হুজুর নামে পরিচিত মাদ্রাসার এক শিক্ষকের মাধ্যমে আরমানকে এই মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিলাম। আমি ‘চকরিয়া হুজুর’ নামে পরিচিত মো. শোয়েবের অত্যাচারের কথা তারেককে জানিয়েছিলাম। উনি (তারেক) তখন বলেছিলেন, আমার ছেলে পড়ালেখা না করার জন্য ভান ধরেছে। আমি শিক্ষকের কথা বিশ্বাস করেছিলাম। মাসে চার হাজার টাকার বিনিময়ে ছেলেকে ওই মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়।
আরমানের বাবা কান্নাজরিত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে আতুরার ডিপোর একটি মাদ্রাসা থেকে হাফেজ হয়ে বের হয়েছে। পাঁচ বছরেই আমার ছেলে হাফেজ হয়েছে। রমজান মাসে ছেলে বন্দরটিলার একটি মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ানোর কথা ছিল। তারা কয়েকদিনের মধ্যেই ছেলেকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকবে বলেছিল। যে কারণে আরেকটু প্রশিক্ষণের জন্য ‘আলী বিন আবী তালিব’ মাদ্রাসায় দিয়েছিলাম। বড় আশা করেছিলাম ছেলের পেছনে নামাজ পড়বো। কিন্তু আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আরমান ছাড়া আমার আর কোনো সন্তান নেই। আমার ছেলেকে ছাদে নিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে আরমানকে খুন করা হয়েছে দাবি করলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছে। গতকাল মরদেহ উদ্ধারের পর দুপুরে সাংবাদিকদের মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘অনেক ছাত্র পড়িয়েছি, অনেক ছাত্র গেছে। এরকম ঘটনা কোনো সময় ঘটেনি। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে। আমাদের কোনো ছাত্র-শিক্ষকের কারণে ঘটনা হয়েছে- আমি মনে করি না। আমি যতটুকু জানি, আরমান ছাদ থেকে জাম্প দিছে অথবা নামতে চেয়ে পড়ে গেছে। ওখানে (ছাদে) যে উঠছে এটার ভিডিও ফুটেজ আছে। প্রশাসন ওইগুলো দেখছে’।
শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে মাদ্রাসা পরিচালক বলেন, আরমানকে যিনি পড়ান, ওনার বয়স না হলেও ৬০ থেকে ৬৫ হবে। উনি তাহাজ্জুদ গুজার, বহুত দিনদার মানুষ। দিনদার হিসেবে উনাকে এখানে আমি রাখছি। উনি আজ প্রায় ১৭ বছর মাদ্রাসায়। শিক্ষকতা করছেন ৩০-৪০ বছরের কম না। সেরকম কোনো অন্যায়-অভিযোগ যদি হয়, তাহলে পরিচালক হিসেবে আমি আছি, আমি এটা সহ্য করব না। শিক্ষকরা একটা অন্যায় করবে, জুলুম করবে, তাহলে এদের নিয়ে আমি মাদ্রাসা করতে চাই না। এ রকম যদি হয়ে থাকে, আল্লাহ পাকের রহমত বন্ধ হয়ে যাবে’।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা এবং ইতোপূর্বেও সংঘটিত কয়েকটি ঘটনার কারণে মাদ্রাসা সম্পর্কে অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট মহলে একটা ভীতির জন্ম নিচ্ছে বলে মনে করছেন সচেতনমহল। অনেকেই নাম না প্রকাশ করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ঘটনার কারণ যাই হোক শিক্ষার্থীর এ ধরনের মৃত্যু অভিভাবকদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে।